বিশেষ সংবাদ:
কুকি-চিন আর্মির সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত (দেশে-বিদেশে) বান্দরবান সদর ও রোয়াংছড়ি জোনের নারী শাখার অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক আকিম বম’কে বান্দরবানের লাইমী পাড়া থেকে র্যাব-১৫ কর্তৃক গ্রেফতার করা হয়েছে ।
কুকি-চিন আর্মি (কেএনএ) বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে সক্রিয় একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। এই সন্ত্রাসী সংগঠনটি বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল বিশেষ করে বান্দরবান জেলায় হত্যা, লুটপাট, ব্যাংক ডাকাতি, অপহরণ ও মুক্তিপণ দাবি’সহ একাধিক সন্ত্রাসী কার্যক্রমে লিপ্ত রয়েছে। বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের কাছে একটি আতঙ্কের নাম এই কুকি-চিন।
গত ০২ এপ্রিল ২০২৪ তারিখ আনুমানিক ২০.১৫ ঘটিকার সময় বান্দরবান পার্বত্য জেলার রুমা থানাধানী রুমা বাজারস্থ সোনালী ব্যাংকে সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি-চিন পূর্ব পরিকল্পিতভাবে অতর্কিত হামলা করে এবং অস্ত্রের মুখে পুলিশ, আনসার ও অন্যান্য লোকজনদেরকে জিম্মি করে অস্ত্র-গোলাবারুদ লুট ও সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার মোঃ নেজাম উদ্দীন’কে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে গত ০৪ এপ্রিল ২০২৪ তারিখ র্যাবের মধ্যস্থতায় সোনালী ব্যাংকের বান্দরবানের রুমা শাখার ম্যানেজার নেজাম উদ্দীন’কে বান্দরবানের রুমা থেকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
এ পর্যন্ত বান্দরবান জেলায় সন্ত্রাস বিরোধী বিভিন্ন অভিযানের মাধ্যমে কুকি-চিন আর্মি (কেএনএ) এর কেন্দ্রীয় কমিটির বান্দরবান সদর শাখার সমন্বয়ক ও প্রধান রসদ সরবরাহকারী চেওসিম বম এবং বান্দরবান সদরস্থ ফারুক পাড়ার কেএনএফ এর সভাপতি সানজু খুম বম’সহ তিনজন কেএনএফ সন্ত্রাসী র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়। এই সন্ত্রাসী সংগঠন কেএনএফ এর সন্ত্রাসী কার্যক্রম নির্মূলে র্যাব-১৫, কক্সবাজার বিশেষ গোয়েন্দা তৎপরতা ও নজরদারী চালু রাখে। এরই ধারাবাহিকতায়, র্যাব-১৫, সিপিসি-৩ বান্দরবান ক্যাম্পের আভিযানিক দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অদ্য ভোর অনুমান ০৬.০০ ঘটিকার সময় বান্দরবান পার্বত্য জেলার সদর থানাধীন লাইমীপাড়া এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে সেবা লাল নুং @ আরামপি @ আকিম বম (১৮), পিতা-সিয়াম থং বম, মাতা-লাল লুং বম, সাং-লাইমিপাড়া, বান্দরবান সদর, বান্দরবান’কে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
গ্রেফতারকৃত আকিম বম’কে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, বিগত ২০২৩ সালে সে কাল্লা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলে অধ্যয়নকালে মাইকেল নামে একটি ছেলের সাথে পরিচয়ের মাধ্যমে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে এবং মাইকেলের মাধ্যমে সে কেএনএ ট্রেনিং এ যেতে আগ্রহ প্রকাশ করে। সেই সুবাদে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শুরু দিকে আকিম ও মাইকেল সন্ধ্যা বেলায় পায়ে হেঁটে কেএনএ এর ট্রেনিং সেন্টারের উদ্দেশ্যে রওনা করে এবং পরবর্তী দিন ভোর পাঁচটার দিকে তারা রোয়াংছড়ির গহীন পাহাড়ী জঙ্গলস্থ ট্রেনিং সেন্টারে পৌঁছায়। সেখানে পৌঁছানোর পর ভান থার ময়-বম নামে কেএনএ এর একজন নারী কমান্ডারের সাথে তাদের পরিচয় হয় এবং ট্রেনিং সেন্টারে তাদেরকে স্বাগত জানায়। এছাড়াও তার ভাষ্যমতে, সেখানে আরো অনেক মেয়ে ছিল, তবে তাদের বেশিরভাগই মুখে কালি মাখতো। তাদের ট্রেনিং সেন্টারের নাম ছিল কেডিওন (ঈশ্বরের দিকে)। আকিম বম’সহ তাদের ব্যাচে ২০ জন প্রশিক্ষণার্থী ছিল। তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করতো ৪-৫ জন এবং প্রশাসনিক কাজের জন্য আলাদা সদস্য নিয়োজিত ছিল। এছাড়া ছদ্মবেশের জন্য মুখে কালি মাখানো আরো অনেকেই ছিল, যাদের গ্রেফতারকৃত আকিম বম চিনতে পারেনি।
ট্রেনিং এর বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, প্রাথমিকভাবে ভোররাত তিনটার দিকে ঘুম থেকে উঠে ট্রেনিং শুরু করতো। প্রশিক্ষণ হিসেবে শারীরিক প্রশিক্ষণ বিশেষ করে মার্শাল আর্ট ট্রেনিং গ্রহণ করতো। তাদের বেত দিয়ে আঘাত করা হতো এবং কষ্টসহ্য করা শেখানো হতো। এছাড়াও লাঠি দিয়ে আঘাত ও টর্চার করা হতো, যাতে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে পারে। প্রশিক্ষণে প্রধানত তাদের জঙ্গলে পাহাড়ি এলাকায় নিজেদের কিভাবে কিভাবে লুকিয়ে রাখতে হয় সেটা শেখানো হতো। এছাড়াও জঙ্গলে বৈরী পরিবেশে কিভাবে টিকে থাকতে হয় সেই প্রশিক্ষণও দিতো। এ সকল প্রশিক্ষণ সকাল ১০টা পর্যন্ত চলমান থাকতো। তারপর ১০টার দিকে খাবার দেয়া হতো। প্রশিক্ষণকালে তারা সাধারণত ভাত ও কলার ভুঁড়ি খেয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতো। মাঝে মধ্যে বনের পাখি, কাঠবিড়ালি শিকার করতে পারলে তা রান্না করে খেতে দিতো। উল্লেখ্য, প্রশিক্ষণরত কেএনএ সদস্যরা সাধারণত প্রতি সাত দিন পর তাদের মুখের কালি পরিবর্তন করতো।
ট্রেনিংয়ে সব সময় মেয়েরা নেতৃত্ব দিতো, বিশেষ করে ভান থার ময়-বম নেতৃত্বে ছিল। তবে ছেলেরা এসে ভান থার ময়-বমকে দিক-নির্দেশনা দিতো। প্রাপ্ত নির্দেশনানুযায়ী প্রশিক্ষণার্থীদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। প্রশিক্ষণে থাকা মেয়েদের একদলে ৫০ জন উত্তীর্ণ হয়েছে বলে সে জানিয়েছে। তাদের ব্যাচে ট্রেনিং চলাকালীন সেখানে মাঝে মাঝে প্রশিক্ষণে থাকা ছেলেরা আসতো। প্রায় তিন শতাধিক পুরুষ সদস্য প্রশিক্ষণরত অবস্থায় ছিল বলে সে জানায়। এছাড়া রুমা এলাকায় আরো দেড় শতাধিক নারী-পুরুষ প্রশিক্ষণরত ছিল। সাধারণত ছেলেদের সাথে মেয়েদের যোগাযোগের সুযোগ দেওয়া হতো না এবং ছেলেদের মুখে কালি মাখানো থাকতো।
গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
Leave a Reply