বিশেষ সংবাদ:
বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (বিপিএসসি) প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় বিপিএসসি’র সাবেক চেয়ারম্যানের গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তাদের মধ্যে বিপিএসসি’র উপপরিচালক, সহকারী পরিচালক ও আবেদের ছেলে ছাত্রলীগ নেতা সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম রয়েছেন। গত রোববার দেশের বিভিন্ন স্থানে এ অভিযান চালানো হয়।
এদিকে, সিআইডির হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর আবেদ আলীর গ্রামের বাড়িসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিয়ে তাঁর কোটি কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। ঢাকায় ফ্ল্যাট-প্লটসহ তাঁর একাধিক বাড়ি রয়েছে। ছেলে ও স্ত্রীর সংগ্রহে রয়েছে বিলাসবহুল কয়েকটি গাড়ি। এ ছাড়া সরকারি জমি দখল করে গরুর খামার গড়ে তোলার অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে রয়েছে কোটি কোটি টাকার জমি। বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসসহ বিভিন্ন দপ্তরে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তিনি এসব সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সিআইডির অভিযানে গ্রেপ্তার অন্য ১৫ জন হলেন– বিপিএসসি’র উপপরিচালক আবু জাফর, উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক আলমগীর কবির, ডেসপাস রাইডার খলিলুর রহমান, অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম, অডিটর প্রিয়নাথ রায়, সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য নোমান সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের রাজনীতি করা ব্যবসায়ী আবু সোলায়মান মো. সোহেল, ব্যবসায়ী জাহিদুল ইসলাম, ঢাকার ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অফিসের মামুনুর রশীদ, ব্যবসায়ী দুই ভাই সাখাওয়াত হোসেন ও সায়েম হোসেন, বেকার যুবক লিটন সরকার, নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তাকর্মী শাহাদাত হোসেন ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টেকনিশিয়ান নিয়ামুন হাসান।
সোমবার সন্ধ্যায় সিআইডির মুখপাত্র বিশেষ পুলিশ সুপার আজাদ রহমান জানান, প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বিষয়ে আরও বিস্তারিত খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।
জানা যায়, বিপিএসসি’র সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলীকে নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তাঁর বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায় রাজনৈতিক-সামাজিক কর্মকাণ্ড ও দান করার বিষয়ে নানা খবর। পরিবার অসচ্ছল হওয়ায় মাত্র আট বছর বয়সে জীবিকার তাগিদে আবেদ আলী পাড়ি জমান ঢাকায়। সে সময় অনেক কষ্টে দিন কাটাতেন তিনি। এরপর শেখেন গাড়ি চালানো। চাকরি নেন বিপিএসসিতে। দিনে দিনে জড়িয়ে পড়েন বিসিএসসহ বিপিএসসি’র অন্যান্য পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস চক্রে।
মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার পশ্চিম বোতলা গ্রামের মৃত জবেদ আলী মীরের ছেলে আবেদ চার ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয়। প্রথম পর্যায়ে কষ্টে দিন কাটলেও প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িয়ে অঢেল সম্পদের মালিক বনে যান তিনি। কয়েক বছর আগে বিপিএসসি’র প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্য হিসেবে নাম প্রকাশের পর গা-ঢাকা দেন। তবে সম্প্রতি ডাসার উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়ে ফের আলোচনায় আসেন। এ সময় কোটি টাকার গাড়িতে চড়ে জনসংযোগ করেন আবেদ ও তাঁর ছেলে।
নির্বাচনের আগে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অসহায় মানুষের মন জয় করতে দান করা শুরু করেন। মানবতার ফেরিওয়ালা হিসেবে প্রমাণ করতে আবেদ আলী নিজে ও তাঁর ছেলে ফেসবুকের মাধ্যমেও সরব হয়ে ওঠেন।
স্থানীয়রা জানান, আবেদ গ্রামের বাড়িতে বিলাসবহুল ভবন নির্মাণ করেছেন। বাড়ির পাশে করেছেন মসজিদ। এ ছাড়া রাস্তার পাশে সরকারি জায়গা দখল করে নির্মাণ করেছেন গরুর খামার ও শপিং সেন্টার। উপজেলার পান্তাপাড়া ও পূর্ব বোতলা গ্রামে করেছেন বিপুল সম্পদ। ঢাকার উত্তরায় ১২ তলা, মিরপুরে ৮ তলা বাড়ি রয়েছে। গত কোরবানির ঈদে দামি গাড়িতে চড়ে ১০০ জনকে এক কেজি করে মাংস দিয়েছেন তিনি। সেই ভিডিও শেয়ার করেছেন ফেসবুকে।
সম্প্রতি সড়ক ও জনপথের জায়গা দখল করে গরুর খামার তৈরি করতে গিয়ে ফের আলোচনায় আসেন তিনি। সড়ক বিভাগ স্থাপনাটি ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয়। তবে নির্দেশনা অমান্য করে স্থাপনাটি অপসারণ থেকে বিরত থাকেন তিনি। দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করে সেই ছবি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের দেখিয়ে সুবিধা নেওয়ার কথাও শোনা গেছে।
সোমবার ফেসবুকে তাঁকে নিয়ে নানা রকম পোস্ট দেখা যায়। বেশির ভাগ পোস্টে তাঁকে ট্রল করা হয়েছে। সমুদ্রসৈকতে নামাজ পড়া, গাড়ির ওপরে বসে নামাজ পড়া এবং মানবতার ফেরিওয়ালা শব্দটি নিয়েও হচ্ছে ট্রল। অনেকে প্রশ্ন ছুড়েছেন– এত সম্পদের উৎস কোথায়? আবেদ আলী ও তাঁর ছেলে সিয়ামের নানা কর্মকাণ্ডের ছবিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এরপর গা-ঢাকা দিয়েছেন পরিবারের সবাই।
এ ঘটনার পর আত্মগোপনে থাকায় ও মোবাইল ফোন বন্ধ রাখায় আবেদ আলীর পরিবারের কারও সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
বিপিএসসি থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ প্রসঙ্গে বিপিএসসি’র চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন সমকালকে বলেন, অভিযোগ তদন্ত করে দেখা হবে। অনিয়মের প্রমাণ পেলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ছাত্রলীগের পদ হারালেন ছেলে সিয়াম
আবেদ আলীর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়ামকে গ্রেপ্তারের পর ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের ত্রাণ ও দুর্যোগবিষয়ক সম্পাদক পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তিনি ডাসার উপজেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি বলেও জানা যায়।
সোমবার রাতে ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সভাপতি রিয়াজ মাহমুদ ও সাধারণ সম্পাদক সাগর আহমেদ শামীমের সই করা যৌথ বিবৃতিতে বিষয়টি জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, সংগঠনের নীতি ও নৈতিকতা পরিপন্থি কার্যকলাপে জড়িত থাকায় তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হলো।
কুয়াকাটার হোটেল নিয়ে যা জানা গেল
পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় সান মেরিনা হোটেল নিয়ে সৈয়দ আবেদ আলী তাঁর ফেসবুক আইডিতে গত ১৮ মে পোস্ট দেন। এতে তিনি লেখেন, ‘আমাদের নতুন হোটেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলাম আজ। সমুদ্রকন্যার পাড়ে আজীবন নিজের জন্য একটা থাকার ব্যবস্থা ও একই সঙ্গে একটা হোটেলের মালিকানা অর্জন করতে আপনিও শেয়ার কিনতে পারেন। শেয়ার কিনতে যোগাযোগ করুন।’
জানা যায়, সান মেরিনা হোটেল এখনও নির্মিত হয়নি। এর মূল মালিক লিবার্টি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোশারফ হোসেন। হোটেল নির্মাণের জায়গাটি খালি পড়ে রয়েছে। তবে নির্মাণকাজ শুরুর জন্য সব প্রস্তুত করা হচ্ছে।
মোশারফ হোসেন নিজেকে সান মেরিনা হোটেলের মূল মালিক হিসেবে দাবি করেন। তিনি বলেন, হোটেলের শেয়ার বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখে একটি শেয়ার কিনতে আগ্রহ দেখান আবেদ। আমার লোকের কাছ থেকে ক্রয়ের বিস্তারিত জেনে যান তিনি। আবেদ আলীকে টাউট প্রকৃতির বলে মনে হয়েছে। এ বিষয়ে থানায় জিডি করব।
প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ বিপিএসসি’র প্রত্যাখ্যান
বিসিএসসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উত্থাপনের অবকাশ নেই বলে জানিয়েছে বিপিএসসি। অন্য বছরগুলোর সব পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে দাবি করে তারা। সোমবার রাতে কমিশন থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি করা হয়। এতে বলা হয়, ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত রেলওয়ের নন-ক্যাডার ‘উপসহকারী প্রকৌশলী’ পদের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস বা প্রতারণা বা অন্য কোনো অবৈধ কার্যক্রমের সঙ্গে কেউ জড়িত প্রমাণিত হলে কমিশন সংশ্লিষ্টের বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত এক যুগে বিসিএসসহ ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে বলে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বাস্তবতা হলো, গত ১২ বছরে বিপিএসসিতে অনুষ্ঠিত বিসিএস ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষা সম্পর্কে কোনো মহল থেকে কখনোই কোনো ধরনের অভিযোগ বা অনুযোগ ছিল না। তাই এটি প্রমাণিত যে, ওই সব পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সময়ে অনুষ্ঠিত বিসিএস ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে নতুন করে কোনো অভিযোগ উত্থাপনের অবকাশ নেই।
তথ্যসূত্র-সমকাল
Leave a Reply