বিশেষ প্রতিবেদন:
গ্রামীণ টেলিকমে শ্রম আইন লঙ্ঘনের আলোচিত মামলাটির রায় ঘোষণা হয় সোমবার বিকেলের দিকে। রাজধানীর বিজয়নগরে শ্রম আদালত ভবনটি অবশ্য এদিন অনেক আগে থেকেই ব্যাপক পুলিশি পাহারায় মুড়ে দেয়া হয়েছিল।এ মামলার আসামি নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বেলা একটা ৪০ মিনিটের দিকে তার আইনজীবীদের সঙ্গে নিয়ে আদালত প্রাঙ্গণে আসেন।
বেলা একটা ৪৩ মিনিটে মুহাম্মদ ইউনূস-সহ এ মামলার চারজন আসামি আদালত কক্ষে ঢোকেন। এ সময় গ্রামীণ চেকের জামা পরা ড. ইউনূস বেশ হাস্যেজ্জ্বল ছিলেন।
আদালত কক্ষে ঢুকে একেবারে বামে বসার সারির দ্বিতীয় বেঞ্চে একসাথে ড. ইউনূস-সহ মোট চারজন আসামি বসেন।
এ সময় তার আইনজীবীরা ছাড়াও আদালতে উপস্থিত ছিলেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক মহাসচিব আইরিন খান, দৃকের প্রতিষ্ঠাতা শহীদুল আলম, তার স্ত্রী রেহনুমা আহমেদ, মানবাধিকার কর্মী ফরিদা আখতার।
এ ছাড়াও ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুরশিদ-সহ অনেকেই।
মুহাম্মদ ইউনূস আসার পরপরই তারা তার সাথে কথা বলেন, করমর্দন করেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ব্যারিস্টার সারা হোসেনকে এ সময় অধ্যাপক ইউনূসের সাথে অনেকক্ষণ কথা বলতে দেখা যায়।
তবে তখনও আদালতের বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয় নি। পুরো আদালত কক্ষ ছিলো এ সময় কানায় কানায় পরিপূর্ণ। আদালত কক্ষে ছিলেন দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা।
আদালতের ঘড়িতে যখন দুপুর দুইটা ১৪ মিনিট, তখন এজলাসে আসেন তৃতীয় শ্রম আদালতের বিচারক শেখ মেরিনা সুলতানা। রায় ঘোষণার শুরুতেই বিচারক আসামিপক্ষের আগে করা দুইটি আবেদন নামঞ্জুর করেন।
পরে তিনি জানান, রায়টি বড় হবে। এ ফোর সাইজে ৮৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়।
তিনি বলেন,“পুরো রায় পড়ছি না। যতটুকু পড়া যায় ততটুকুই পড়ছি।”। আইনজীবীদের পরে রায়ের সার্টিফায়েড কপি সংগ্রহ করে নেয়ার জন্য বলেন বিচারক শেখ মেরিনা সুলতানা।
বিচারক এ সময় মামলাটি হওয়ার বিস্তারিত প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ২০২০ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি কলকারখানা অধিদপ্তরের পরিদর্শক প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শনে গিয়ে শ্রম আইনের লঙ্ঘন দেখতে পায়। পরে তা সংশোধনের জন্য বিবাদী পক্ষকে ১লা মার্চ চিঠি দেয়া হয়।
কিন্তু বিভিন্ন সংশোধনের পর গ্রামীণ টেলিকমের পক্ষ থেকে এর জবাবে ৯ই মার্চ যে চিঠি দেয়া হয় কর্তৃপক্ষের মতে তা সন্তোষজনক ছিল না।
পরে কলকারখানা অধিদপ্তর শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ড. ইউনূস-সহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলাটি করে। অন্যান্য আসামিরা হলেন, আশরাফুল হাসান, নুরজাহান বেগম, মো. শাহজাহান।
এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে সেগুলো হলো শিক্ষানবীশকাল পার হওয়ার পর চাকরি স্থায়ী করা হয় নি, প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আইনানুযায়ী বাৎসরিক মজুরি-সহ ছুটি দেয়া হয় না ইত্যাদি।
এছাড়া ছুটির নগদায়ন করা হয় না এবং ছুটির বিপরীতে নগদ অর্থও দেয়া হয় না বলে জানানো হয়। অন্যান্য অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিল গঠন করা হয় নি, লভ্যাংশের পাঁচ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইনানুযায়ী গঠিত তহবিলে জমা দেয়া হয় নি।
আদালত বলেন, এসব অভিযোগে চার্জ গঠনের পর কলকারখানা অধিদপ্তরের দেয়া চারজন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। তাদের জেরা করেছে আসামিপক্ষ। ড. ইউনূসসহ আসামিরা নিজেদের নির্দোষ দাবি করে সাফাই সাক্ষ্য দেননি বলে উল্লেখ করেন শ্রম আদালতের বিচারক।
পরে উভয়পক্ষের আইনজীবীরা শুনানিতে যা বলেছেন তার কিছু কিছু অংশ তুলে ধরেন বিচারক।
এ সময় আদালত বলেন, “আসামিপক্ষের আইনজীবী এ মামলার এক নম্বর আসামি ড. ইউনূস সম্পর্কে বলেছেন, তিনি সারা বিশ্বে শিক্ষা, স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানে কাজ করেছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের মতো রোল মডেল তৈরি করেছেন। দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিশ্বব্যাপী শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন।”
বিচারক উল্লেখ করেন, “এখানে নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের বিচার হচ্ছে না। ড. ইউনূস যিনি গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান, তার বিচার হচ্ছে”।
এরপর পুরো মামলায় উভয়পক্ষের শুনানি ও যুক্তি উপস্থাপন বিশ্লেষণ করে বলেন, “বিবাদীরা স্বীকার করেছেন ড. ইউনূসসহ আসামিরা পরিচালনা পর্ষদে আছেন। আসামিদের দায়বদ্ধতা ছিল না তা বলা যায় না”
Leave a Reply