ডেস্ক রিপোর্ট : ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) শীর্ষ কমান্ডার কাসেম সোলাইমানির চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণসভায় জোড়া বোমা হামলার ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১০৩ জনে দাঁড়িয়েছে।
দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় শহর কেরমানে বুধবারের এ ঘটনায় আরও অন্তত ১৪১ জন আহত হয়েছেন। এখানে সোলাইমানির সমাধিস্থলের কাছে ওই স্মরণসভার আয়োজন করা হয়েছিল।
দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কেরমানের জরুরি পরিষেবা বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ সাবেরি।
এক বিবৃতিতে সাবেরি বলেন, ‘বোমা হামলায় ঘটনাস্থলেই ৭৩ জন নিহত হন। আর বোমায় গুরুতর আহতদের অধিকাংশই হাসপাতালে নেয়ার পর মারা যান। বর্তমানে হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছেন আরও ১৪১ জন। তাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর।’
হামলার বিবরণ
ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ইরনা জানায়, প্রথম বোমাটি বিস্ফোরিত হয় সোলাইমানির সমাধিস্থলের ৭০০ মিটার দূরে। একটি পুজো কারের ভেতর স্যুটকেসের মধ্যে রাখা ছিল বোমাটি। রিমোট কন্ট্রোলারের সাহায্যে সেটির বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
রাষ্ট্রীয় সংবাদ চ্যানেল আইআরআইবি-কে দেয়া সাক্ষাৎকারে ইরানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহমাদ ওয়াহিদি বলেন, ‘প্রথম বিস্ফোরণটি ঘটে স্থানীয় সময় বুধবার বিকেল ৩টার দিকে। বিস্ফোরণে আহতদের উদ্ধার করতে যখন সভায় উপস্থিতরা ঘটনাস্থলে জড়ো হন, তখন অর্থাৎ ২০ মিনিট পর দ্বিতীয় বিস্ফোরণটি ঘটানো হয়। এটির প্রভাব ছিল ধ্বংসাত্মক।’
এখন পর্যন্ত নৃশংস এই বোমা হামলার দায় স্বীকার করেনি কোনো পক্ষ বা সংগঠন।
বোমা বিস্ফোরণে হতাহত হওয়ার ঘটনায় বৃহস্পতিবার একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে ইরান।
ঘটনার পর ইরানের বিচার বিভাগের প্রধান গোলাম হোসেন মোহসেনি-ইজেই বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এই নৃশংস ঘটনার হোতা ও বাস্তবায়নকারীদের খুঁজে বের করে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে।’
সব তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে অপরাধীদের শনাক্ত করে তাদের ধরে আইনের হাতে তুলে দিতে ইরানের গোয়েন্দা বিভাগ, নিরাপত্তা বিভাগ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে অবিলম্বে কাজ শুরু করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
বোমা হামলার মতো ঘটনা ঘটিয়ে শত্রুরা ইরানের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ প্রয়োগ করছে উল্লেখ করে দেশবাসীকে সতর্ক করেছেন ইরানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইআরজিসি কমান্ডার আহমেদ ওয়াহিদি।
তিনি বলেন, ‘শত্রুদের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে কেউ বিভ্রান্ত হবেন না। কোনো ধরনের গুজবে কান দেবেন না।’
হামলা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে দাবি করে দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনকে তিনি বলেন, ‘পর্যালোচনা ও যাচাই করার পরই তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে।’
ইরানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোস্তফা খোশচেশম আল জাজিরাকে বলেন, ভয়াবহ এই বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহতদের মধ্যে বেশকিছু শিশুও রয়েছে।
জেনারেল সোলাইমানির শাহাদাৎ বার্ষিকীতে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় নিন্দা এবং ইরানের প্রতি সংহতি জানিয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে ইয়েমেনের বিদ্রোহী গোষ্ঠী হুতি।
বিবৃতিতে তারা বলেছে, ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে দুর্বল করার মতো চেষ্টার সমস্ত অপরাধের সম্প্রসারণকে প্রতিনিধিত্ব করে এ হামলা। এ ঘটনার পর ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক ঔদ্ধাত্যের মোকাবিলায় ইরানের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করছে হুতি।’
জোড়া বিস্ফোরণের পর ইরানের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি এবং সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে লেখা এক চিঠিতে পুতিন বলেছেন, ‘সমাধিস্থলে আসা বেসামরিক মানুষের ওপর এমন বর্বরোচিত হামলা চরম নিষ্ঠুরতার প্রকাশ।’
ঘটনাটিকে ‘মর্মান্তিক’ উল্লেখ করে এ ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন তিনি।
নিষ্ঠুর এ হামলার ঘটনায় নিন্দাজ্ঞাপন করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করা এক পোস্টে তিনি বলেছেন, ‘ইরানের কেরমান প্রদেশে চালানো জঘন্য সন্ত্রাসী হামলায় আমরা গভীরভাবে মর্মাহত। যারা হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন আল্লাহ তাদের প্রতি রহম করুন। সেইসঙ্গে যারা আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি।’
‘আমার বন্ধুত্বপরায়ণ ও ভ্রাতৃপ্রতিম ইরানি জনগণের প্রতি আমি সমবেদনা প্রকাশ করছি’, বলেন তিন
বিস্ফোরণে নিহতদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহও।
বিবৃতিতে অপরাধীদের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি নাসরুল্লাহ। তবে বলেছেন, ‘নিহতরা সোলেইমানির মতো সংগ্রামের একই পথে প্রাণ দিয়েছেন।’
তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধ্যপ্রাচ্য অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক হাসান আহমেদিয়ান হামলার ঘটনায় সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি তুলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এই ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর ইরানে এখন একটি প্রশ্নই সব মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে। তা হলো- কে করল এমন কাজ?’
আল জাজিরাকে দেয়া সাক্ষাতকারে তিনি জানিয়েছেন, ‘প্রেসিডেন্ট (ইব্রাহিম রাইসি) অবশ্যই এ ঘটনার নেপথ্যে থাকা কলাকুশলীদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনবেন। তিনি হয়তো প্রতিশোধের কথাও বলবেন। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেল- কে বা কারা এটি ঘটাল?’
‘আইসিস সম্প্রতি যেসব ঘটনা ঘটিয়েছে (ব্যাপক সংখ্যায় হত্যাকাণ্ড), তাতে তাদের দায় থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। আবার ইসরায়েলও এমন ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে।’
এর ব্যাখ্যা হিসেবে তিনি বলেছেন, ‘তারা (ইসরায়েল) হয়তো এমন কিছু চায় যা ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে (সংঘাতে) টেনে আনবে।’
‘এগুলোই বাস্তবিক সম্ভাবনা’, বলেন এ অধ্যাপক।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর চলমান হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধের মধ্যেই এবার উত্তেজনা ছড়াল ইরানে। গত সোমবার সিরিয়ার দামেস্ক উপকণ্ঠে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হন আইআরজিসির আরও এক শীর্ষ নেতা সাইয়েদ রাজি মুসাভি।
মুসাভি আইরাজিসির শীর্ষ কমান্ডার জেনারেল কাসেম সোলাইমানির ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড বাহিনীর জ্যেষ্ঠ এ উপদেষ্টা ইরান ও সিরিয়ার মধ্যে সামরিক জোট সমন্বয়কের ভূমিকায় ছিলেন।
যদিও ওই ঘটনায় সে সময় নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করে ইসরায়েল। তবে ইসরায়েলকে দায়ী করে তাদের ওপর কঠিন প্রতিশোধ নেয়ার অঙ্গীকার করে হিজবুল্লাহ।
তার আগে ইরানের বিরুদ্ধে হামাসকে অর্থায়নের অভিযোগ আনে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। ফিলিস্তিনের শাসকগোষ্ঠীকে অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগ এনে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট গত মাসে বলেছিলেন যে, তার দেশ একটি বহুমুখী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
‘ইরানসহ সাতটি দেশ থেকে ইসরায়েলের ওপর আক্রমণ আসছে। আমরা এরই মধ্যে ছয়টি দেশকে জবাব দিয়েছি। বাকিদের বিষয়েও কাজ করছি’, সে সময় বলেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রও সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক তৎপরতা বাড়িয়েছে। গত মাসে একটি হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের তিন সেনা আহত হওয়ার পর দেশটির সেনাবাহিনী ইরান-সমর্থিত কাতাইব হিজবুল্লাহ ও ইরাকে তাদের ‘সহযোগী গোষ্ঠীর’ ওপর বিমান হামলা চালায়।
এ সমস্ত ঘটনার পর্যালোচনা করে আল জাজিরার জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারা বলেছেন, কয়েক দিনের ব্যবধানে আঞ্চলিক উত্তেজনা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে ‘যুদ্ধের কালো মেঘ’ ঘনীভূত হচ্ছে, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
বিশারা বলেন, ‘এই অঞ্চলে এখন যেকোনো কিছু ঘটতে পারে। এখানে অনেক বেশি হিংস্রতা, উত্তেজনা, আর দ্বন্দ্ব বেড়েছে; অনেকগুলো লড়াই চলমান। লোহিত সাগর, ইরান-ইরাকি সীমান্ত, ইয়েমেন থেকে উপসাগরীয় অঞ্চল সর্বত্র এখন যুদ্ধের চাপা দামামা বাজছে।’
Leave a Reply