বিশেষ প্রতিবেদন :
সরকারি সম্পদ রক্ষা ও সরকারি আইন কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে ফের স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস আইন করার বিষয়টি ভাবছে অন্তর্বর্তী সরকার। উচ্চ আদালতে রাষ্ট্রের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রায় এক লাখ মামলা ঝুলছে। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর গাফিলতি ও প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে বেশির ভাগ মামলায় হারছে সরকার। এতে রাষ্ট্র ও সরকারের বিপুল ক্ষতি হচ্ছে।
বেহাত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ। এমন পরিস্থিতিতে স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস আইন ফিরিয়ে আনার বিষয়টি ভাবা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সূত্র জানায়, আইনজীবীদের মানসম্মত জবাব, প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপনে ব্যর্থতা ও তামাদি হওয়ার কারণে অনেক মামলায় হেরে যাচ্ছে সরকার। এ ছাড়া আদালত থেকে মামলাসংক্রান্ত আদেশ সঠিক সময়ে মন্ত্রণালয়ে না পৌঁছার কারণেও অনেক মামলায় আপিল হয় না।
এক পর্যায়ে এসব মামলায় একতরফাভাবে রায় হয়। শুধু গত বছরের শেষ তিন মাসে (অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর) ১৭১টি মামলায় হেরেছে সরকারপক্ষ।
এ ব্যাপারে আইনসচিব মো. গোলাম রব্বানী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমানকে দায়িত্ব দিয়েছে সরকার।
কমিশন যেসব বিষয় সংস্কারের সুপারিশ দেবে, এর মধ্যে স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস একটি। তারা সুপারিশ দেওয়ার পর এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে সরকার।’
ওয়ান-ইলেভেনে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সরকারি অ্যাটর্নি সার্ভিস অধ্যাদেশ-২০০৮ প্রণীত হয়। শেখ হাসিনা সরকার দায়িত্ব নিয়ে ওই অধ্যাদেশের অনুমোদন না দিলে তা বাতিল হয়ে যায়। এরপর ২০১৩ সালের দিকে আরো একটি খসড়া তৈরি করা হয়।
সেই পুরনো অধ্যাদেশ ও খসড়ার আলোকে নতুন করে খসড়া প্রণয়ন করা হতে পারে। প্রক্রিয়া শেষে আইনটি কার্যকর হলে এর অধীনে নিযুক্ত কর্মকর্তারা ‘সরকারি আইন কর্মকর্তা’ হিসেবে গণ্য হবেন। সরকার কোনো মামলায় হারলে এসব কর্মকর্তাকে জবাবদিহি করতে হবে।
জানা গেছে, উচ্চ আদালতের সরকারি স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট মামলা দেখভালে একটি শক্তিশালী কমিটি রয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের শেষ সময়ে তাঁর কার্যালয়ে সেই উচ্চ আদালতে চলমান সরকারি স্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলা পরিচালনা কার্যক্রম পরিবীক্ষণসংক্রান্ত আন্ত মন্ত্রণালয় কমিটির বৈঠক হয়। গত ২৭ মার্চ অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে মন্ত্রিপরিষদসচিব মো. মাহবুব হোসেন সভাপতিত্ব করেন।
সর্বশেষ অনুষ্ঠিত কমিটির ওই সভায় বলা হয়, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৭১টি মামলার রায় সরকারের বিপক্ষে গেছে। একই সময় আগে বিপক্ষে যাওয়া ৪৪১টি মামলায় আপিল করা হয়। যদিও ওই সময় সরকারের বিভিন্ন সংস্থার পক্ষে ৪২৬টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন আদালতে সরকারি স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনিষ্পন্ন মামলা ছিল ৯৫ হাজার ৪৫৫টি।
সভায় তৎকালীন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী বলেছিলেন, সরকারি অফিসগুলোতে যেসব কর্মকর্তা বা কর্মচারী আইন শাখায় কাজ করেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা আইনের বিষয়ে ততটা দক্ষ নন।
অর্থসচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেন, সরকারের পক্ষে নিষ্পত্তি হওয়া আদেশও অনেক সময় আইন বিভাগের কর্মীরা বুঝতে পারেন না। যে কারণে অপ্রয়োজনীয় আপিল হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন বলেছিলেন, কোনো মামলায় গাফিলতি বা দায়িত্বহীনতার প্রমাণ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকারি স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মামলায় অতীতে এমনও দেখা গেছে, পুরো ফাইল গায়েব হয়ে গেছে। আবার ফাইল থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ফেলে দেওয়া হয়েছে। এসব কারণে মামলা সরকারের বিপক্ষে যাচ্ছে। নথির অভাবে এসব মামলায় সরকার আপিল করতে পারেনি বা আপিল করলেও জিততে পারেনি।
এর আগেও একাধিক জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ডিসিরা সরকারি অ্যাটর্নি সার্ভিস আইন দ্রুত প্রণয়নের সুপারিশ করেন। ওই সময় ডিসিরা বলেছিলেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে সরকারের সম্পদ চলে যাবে অবৈধ দখলদারদের হাতে। সে সময়ই ডিসিদের সুপারিশটি বিবেচনায় নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আর্থিক সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে এ পথে হাঁটেননি সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস গত ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমানের নাম ঘোষণা করেন। এর পরই বিষয়টি গতি পায়।
সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ল অ্যান্ড লাইফ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী সভাপতি ব্যারিস্টার মোহাম্মদ হুমায়ন কবির পল্লব কালের কণ্ঠকে বলনে, ‘রাষ্ট্রীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলা পরিচালনায় সরকারি আইনজীবীদের জবাবদিহি না থাকায় তাঁদের যোগসাজশেই বেহাত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আইনজীবী পরিবর্তনের কারণেও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয় না। তাই আইনের মাধ্যমে মেধার ভিত্তিতে আইন কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে পারলে ন্যায়বিচারও নিশ্চিত হবে।’
আগের প্রস্তাবিত খসড়ায় যা ছিল : অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল পদে ৫০ শতাংশ, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল, জেলা অ্যাটর্নি ও অতিরিক্ত জেলা অ্যাটর্নি পদে ২৫ শতাংশ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিধান রেখে অ্যাটর্নি সার্ভিস আইন খসড়া চূড়ান্ত করে সরকার। ২০১৩ সালের এই খসড়ায় অবশিষ্ট পদে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) অধীনে পরীক্ষার মাধ্যমে সরাসরি নিয়োগ করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। প্রস্তাবিত খসড়ায় অ্যাটর্নি সার্ভিসের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানের জন্য একটি অধিদপ্তর গঠনের কথা বলা হয়, যা নিয়ন্ত্রণ করবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
ওয়ান-ইলেভেনের সময়ের অধ্যাদেশে অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ ছিল আইন মন্ত্রণালয়ের হাতে। সেখানে শুধু অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল পদে ৫০ শতাংশ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিধান ছিল। অন্য পদে সরাসরি পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগের কথা বলা হয়।
Leave a Reply