বিশেষ প্রতিবেদন :
সিরিয়ায় দুই যুগ ধরে ক্ষমতায় ছিলেন বাশার আল-আসাদ। এর মধ্যে প্রায় এক দশক তাঁকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে বড় ভূমিকা পালন করে রাশিয়া।
তবে সিরিয়ায় গতকাল রোববার বিস্ময়কর এক ঘটনা ঘটে যায়। বিদ্রোহীদের অভিযানে বাশার আল-আসাদের পতন হয়েছে। তিনি রাশিয়ায় পালিয়ে গেছেন।
ক্রেমলিনের একটি সূত্রের বরাত দিয়ে রুশ সংবাদ সংস্থা ও দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জানিয়েছে, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাশার আল-আসাদ ও তাঁর পরিবারকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে মস্কো।
মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে ক্রেমলিনের ‘সিরিয়া প্রকল্পের’ সবচেয়ে নাটকীয় দিক উন্মোচিত হলো। আর দেখা গেল, এ পরিস্থিতি সামাল দিতে মস্কো ক্ষমতাহীন।
এক বিবৃতিতে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, সিরিয়ার নাটকীয় পরিস্থিতির প্রতি অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে নজর রাখছে মস্কো।
বাশার আল-আসাদ সরকারের পতন রাশিয়ার মর্যাদার জন্য একটি আঘাত।
তুমুল গৃহযুদ্ধের জেরে ২০১৫ সালে পতনের প্রায় দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন সিরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ। সে সময় তাঁকে রক্ষা করার জন্য হাজারো সেনা পাঠিয়েছিল রাশিয়া।
অবশ্য সিরিয়ায় রুশ সেনা পাঠানোর পেছনে মস্কোর কিছু উদ্দেশ্য ছিল। এর মধ্যে একটি হলো বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে নিজের অবস্থান জানান দেওয়া।
বাশার আল-আসাদ সরকারকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার বিনিময়ে সিরিয়ার কর্তৃপক্ষ রাশিয়াকে হামিমিমের বিমানঘাঁটি ও টারতুসের একটি নৌঘাঁটি ৪৯ বছরের জন্য ইজারা দেয়। এর মধ্য দিয়ে রাশিয়া পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরির সুযোগ পায়। এসব ঘাঁটি আফ্রিকায় সামরিক সরঞ্জাম স্থানান্তরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে। মস্কোর জন্য এখন বড় প্রশ্ন হলো, সিরিয়ায় রাশিয়ার ঘাঁটিগুলোর কী হবে?
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পশ্চিমা ক্ষমতা ও আধিপত্যের প্রতি এটি ছিল রাশিয়ার ছুড়ে দেওয়া বড় কোনো চ্যালেঞ্জ। আর এ ক্ষেত্রে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সফল হন বলেও প্রতীয়মান হয়।
২০১৭ সালে পুতিন সিরিয়ায় অবস্থিত রাশিয়ার হামিমিম বিমানঘাঁটি পরিদর্শন করেন। সে সময় তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে মস্কোর সিরিয়া মিশন সম্পন্ন হয়েছে।
বিভিন্ন প্রতিবেদনে নিয়মিতভাবে বলা হচ্ছিল, রুশ বিমান হামলায় সিরিয়ায় বেসামরিক মানুষ হতাহত হচ্ছেন। এমন প্রতিবেদন সত্ত্বেও সিরিয়ায় রাশিয়ার সামরিক অভিযান দেখানোর জন্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে আমন্ত্রণ জানানোর ব্যাপারে মস্কো যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী ছিল।
এমনই এক সফরে সিরিয়ায় গিয়েছিলেন বিবিসির এই প্রতিবেদনের লেখক স্টিভ রোজেনবার্গ। তাঁকে এক কর্মকর্তা বলেছিলেন, দীর্ঘ সময়ের জন্যই সিরিয়ায় এসেছে রাশিয়া।
কিন্তু এখন সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ সরকারের পতন রাশিয়ার মর্যাদায় আঘাতের চেয়েও অনেক বড় একটি বিষয় আছে।
বাশার আল-আসাদ সরকারকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার বিনিময়ে সিরিয়ার কর্তৃপক্ষ রাশিয়াকে হামিমিমের বিমানঘাঁটি ও টারতুসের একটি নৌঘাঁটি ৪৯ বছরের জন্য ইজারা দেয়।
এর মধ্য দিয়ে রাশিয়া পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরির সুযোগ পায়। এসব ঘাঁটি আফ্রিকায় সামরিক সরঞ্জাম স্থানান্তরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনফাইল ছবি: রয়টার্স
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের এক উপস্থাপক বলেন, সিরিয়ার বিরোধী নেতারা দেশটির ভূখণ্ডে থাকা রুশ সামরিক ঘাঁটি ও কূটনৈতিক মিশনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছেন।
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, সিরিয়ায় অবস্থিত রুশ ঘাঁটিগুলোকে উচ্চ সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে। তবে মন্ত্রণালয় এই দাবি করে যে বর্তমানে এসব ঘাঁটি কোনো গুরুতর হুমকির মুখে নেই।
বাশার আল-আসাদ ছিলেন মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার একনিষ্ঠ মিত্র। ক্রেমলিন তাঁর পেছনে প্রচুর বিনিয়োগ করেছিল।
রাশিয়ার কর্তৃপক্ষ এখন বাশার আল-আসাদ পতনকে মস্কোর জন্য একটি বড় ধাক্কা ছাড়া অন্য কিছু দেখাতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। তবুও দেশটি চেষ্টা করছে। তারা বলির পাঠা খুঁজছে।
গতকাল রাতে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের সাপ্তাহিক সংবাদভিত্তিক একটি অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু ছিল সিরিয়ার বাশার আল-আসাদপন্থী সেনাবাহিনী। অনুষ্ঠানে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব নিয়ে পাল্টা লড়াই না করার জন্য সিরিয়ার সেনাবাহিনীকে দোষারোপ করা হয়।
অনুষ্ঠানটির উপস্থাপক ইয়েভজেনি কিসলেভ বলেন, সবাই দেখতে পাচ্ছিল যে সিরিয়ার কর্তৃপক্ষের জন্য পরিস্থিতি আরও নাটকীয় হয়ে উঠছে। কিন্তু আলেপ্পোতে কী দেখা গেল, কোনো লড়াই ছাড়াই সেনাবাহিনী নিজেদের অবস্থান ছেড়ে দিল। সুরক্ষিত এলাকাগুলোর নিয়ন্ত্রণ তারা একের পর এক ছেড়ে দিল। অথচ, বিদ্রোহীদের তুলনায় সিরিয়ার সেনাবাহিনী সংখ্যায় বেশি ছিল। তারা অস্ত্রশস্ত্রেও সুসজ্জিত, সমৃদ্ধ ছিল। এই বিষয়গুলো অত্যন্ত রহস্যজনক।
ইয়েভজেনি কিসলেভ দাবি করেন, রাশিয়া সব সময়ই সিরিয়ায় বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সমঝোতার আশা করে এসেছিল। অবশ্যই সিরিয়ায় যা ঘটছে, তা নিয়ে তাঁরা উদাসীন নন। তবে মস্কোর অগ্রাধিকার হলো, রাশিয়ার নিজস্ব নিরাপত্তা। অগ্রাধিকার হলো, ইউক্রেনে রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযান।
Leave a Reply