বিশেষ প্রতিবেদন :
ব্যাংকারদের মতে, ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থা ধীরে ধীরে ফিরতে থাকায় এবং অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে আর্থিক অনিয়ম কম হওয়ায় ব্যাংকে টাকা রাখার পরিমাণ বাড়ছে
টানা দশ মাস ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ বাড়তে থাকার পর, ধীর গতিতে হলেও গত দুইমাস ধরে ব্যাংকে ফিরতে শুরু করছে এসব টাকা।
ব্যাংকারদের মতে, ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থা ধীরে ধীরে ফিরতে থাকায় এবং অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে আর্থিক অনিয়ম কম হওয়ায় ব্যাংকে টাকা রাখার পরিমাণ বাড়ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত অক্টোবর মাসে আগের মাসের তুলনায় ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ কমেছে ৫,৭৪৩ কোটি টাকা। অক্টোবর শেষে মানুষের হাতে ২.৭৮ লাখ কোটি টাকা রয়েছে।
অবশ্য গতবছরের একই সময়ের তুলনায় এটি প্রায় ১৩ শতাংশ বেশি। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে এর পরিমাণ ছিল ২.৮৪ লাখ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদদের মতে, ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ বেড়ে গেলে সেটি অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর হয়। কারণ, ব্যাংকের বাইরে থাকলে টাকার হাতবদল হওয়া কমে যায়, যেটি দিনশেষে মানি ক্রিয়েশন কমিয়ে দেয়।
মানুষের হাতে থাকা টাকা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ব্যাংকে ফিরলে একদিকে যেমন ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি ভালো হয়, অন্যদিকে ঋণযোগ্য তহবিলের পরিমাণ বাড়ায় দেশে বিনিয়োগ বাড়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়।
ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মারুফ টিবিএসকে বলেন, রাজনৈতিকসহ নানান অস্থিরতা ও অনিয়মের কারণে ব্যাংক খাতে গ্রাহকদের আস্থার কিছুটা সংকট তৈরি হয়েছিল। এছাড়া মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের হাতে নগদ টাকা রাখার প্রবণতাও বেড়েছিল।
“তবে গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে ব্যাংকে টাকা ফেরত আসার মাধ্যমে আমরা গ্রাহকদের আস্থা ফিরে আসার বিষয়টিকেই দেখতে পাচ্ছি। গ্রাহকের আস্থা ফেরাতে ব্যাংকগুলো নতুন হিসাব খুলতে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি কাস্টমার সার্ভিস ডেভেলপমেন্টসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছে,” বলেন তিনি।
ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ টাকার একটা বড় অংশ কালো টাকার মালিকদের কাছে থেকে থাকতে পারে মন্তব্য করে এই ব্যাংকার বলেন, “অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দুর্নীতি কমেছে বলে অনেকের মতো আমিও ধারণা করছি। ফলে অর্থনীতিতে কালো টাকার প্রভাব কিছুটা হলেও কমেছে, যার কারণে ব্যাংক খাতে টাকা ফিরছে।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ ছিল ২.৪৬ লাখ কোটি টাকা। মূল্যস্ফীতির চাপের কারণে এরপর থেকে প্রতি মাসেই এই পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে।
পরে গত জুলাই শেষে ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ সর্বোচ্চ ২.৯২ লাখ কোটিতে পৌঁছায়। বেশ কয়েকদিন ইন্টারনেট বন্ধ এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তবর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়াসহ নানান কারণে অগাস্টে ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যহত হওয়ায় ওই মাসে ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ খুব বেশি বাড়েনি। সেপ্টেম্বর থেকে ফিরতে শুরু করে ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকা।
অক্টোবরে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ব্যাংকে জমা টাকার পরিমাণ ৭.২৮ শতাংশ বেড়ে ১৭.৫৫ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছায়। আগের মাসের তুলনায় আমানতের পরিমাণ বাড়ে ১৪,২০৮ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, সেপ্টেম্বরে ব্যাংকে জমা বৃদ্ধির হার ছিল ৭.২৬ শতাংশ।
আর আগস্টে বার্ষিক জমা প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ৭.০২ শতাংশে— যা ছিল ১৮ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংকে টাকা জমা প্রবৃদ্ধির সর্বনিম্ন রেকর্ড ছিল ৬.৮৬ শতাংশ।
বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যেও ভালো ব্যাংকগুলোতে ডিপোজিট বা আমানত অনেক বেড়েছে। পাশাপাশি দুর্বল ব্যাংকগুলোতে টাকা রাখতে গ্রাহকেরা ভরসা পাচ্ছেন না। তারা দুর্বল ব্যাংকগুলো থেকে টাকা তুলে ভালো ব্যাংকগুলোতে এনে জমা করছেন। তারল্য পরিস্থিতি ভালো থাকায় এবং ঋণের চাহিদা কম থাকায় ভালো ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে।
একটি শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানিয়েছেন, গ্রাহকেরা এখন আগের তুলনায় অনেক সচেতন হয়েছেন। আগে তারা বেশি সুদহার দেখে ব্যাংকে টাকা রাখতেন। তবে এখন সুদহারের বদলে একটি ব্যাংকের সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় নিচ্ছেন। এটি গ্রাহক তো অবশ্যই, ব্যাংকগুলোর জন্যও ভালো।
তিনি বলেন, “এতে যেসব ব্যাংক একটা সময় নীতিমালার তোয়াক্কা না করে কার্যক্রম চালিয়েছে, তারা সে রাস্তা থেকে সরে এসেছে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে শুরু করায় গ্রাহকেরা ধীরে ধীরে ব্যাংকের প্রতি আস্থা ফিরে পাচ্ছেন।”
Leave a Reply