বিশেষ প্রতিবেদন :
রেমিট্যান্সের ডলারের দর ক্রমাগত বাড়তে থাকায় আমদানি এলসি (লেটার অফ ক্রেডিট) নিষ্পত্তির ডলারের দাম বেড়ে ১২৩.৮০-১২৫ পৌঁছেছে। এতে আমদানি খরচ বেড়ে গিয়ে তা মূল্যস্ফীতিকে আরও উস্কে দিতে পারে বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা।
অন্তত ৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) ব্যাংকগুলো ১২৪.৮০-১২৫.৬০ টাকা দরে রেমিট্যান্সের ডলার সংগ্রহ করেছে।
এর মাত্র একদিন আগে, ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ১২৪.২০ টাকা দরে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করেছিল। এর আগে ২০২৩ সালের নভেম্বরে ফর্মাল চ্যানেলে রেমিট্যান্সের ডলারের সর্বোচ্চ দর উঠেছিল ১২৬ টাকা।
রেমিট্যান্সের রেট বেড়ে যাওয়ার জের ধরে এলসি নিষ্পত্তির ডলার রেট দুইদিনের ব্যবধানে অন্তত ১ টাকা বেড়ে সর্বোচ্চ ১২৫ টাকায় পৌঁছেছে। এর আগে, ব্যাংকগুলো গ্রাহকভেদে ১২২-১২৪ টাকা দরে গ্রাহকদের কাছে ডলার বিক্রি করতো।
একটি বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজের কান্ট্রিহেড টিবিএসকে বলেন, “ব্যাংকগুলোতে ডলারের চাহিদা এখন আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। গত দুইদিনে রেমিট্যান্সের ডলারের দর প্রায় ১.৫ টাকা বেড়েছে। বৃহস্পতিবার আমাদের কাছে অনেক ব্যাংক ডলার কিনতে চেয়েছে। আমরা ১২৪.৪০-১২৪.৬০ টাকা দরে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার দিয়েছি।”
গ্রাহকেদের পক্ষ থেকে ব্যাংকের কাছে ডলার চাহিদা বাড়ার উদাহরণ দিয়ে এ কর্মকর্তা বলেন, “এমনও ঘটনা ঘটেছে, গ্রাহককে পাশে বসিয়ে ব্যাংকগুলো আমাদের কাছে ডলার কেনার জন্য ফোন দিচ্ছে। গ্রাহকের সম্মতি নিয়েই তারা বেশি দামে ডলার কিনে নিচ্ছে। অর্থাৎ, গ্রাহকেরা ডলার ম্যানেজ করার ঝোঁক বাড়িয়ে দিয়েছে।”
মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব
এদিকে, আগামী কয়েক সপ্তাহে রমজানের পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলা শুরু হবে। তখন ডলারের দর এমন থাকলে, তা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ না হওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে সতর্ক করেছেন ব্যাংকাররা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের (এমটিবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “রেমিট্যান্সের ডলারের রেট বেশ বেড়েছে, ফলে এর জের ধরে এলসি সেটেলমেন্টেও ডলারের রেট বেড়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে বড় কিছু পেমেন্টের চাপ থাকতে পারে। ফলে সেটি ডলারের রেটে প্রভাব ফেলবে এটিই স্বাভাবিক।”
ডলারের দর বাড়ায় সেটি মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে মন্তব্য করে এই ব্যাংকার বলেন, “ডলারের দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতিজনিত চাপ আসতে পারে। তবে সেটি খুব বেশি হবে বলে এখনই মনে হচ্ছে না।”
ডলার দর নিয়ে উদ্বেগ
একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “আমরা বেশি দামে ডলার কেনা নিয়ে শঙ্কিত। রেমিট্যান্স এখন অনেক বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে। এক্সপোর্ট প্রসিডের ডলার কেনার ক্ষেত্রে ১১৯-১২০ টাকা রেট দিতে হচ্ছে। ফলে আমাদের ডলার কেনার গড় দাম বেড়ে যাচ্ছে। সে ধারাবাহিকতায় বিক্রির দামও বাড়ছে।”
তিনি বলেন, “বৃহস্পতিবার পেট্রোবাংলার একটি পেমেন্ট করা হয়েছে ১২৪ টাকা রেটে। এই পেমেন্টে আমরা কোনো লাভ করিনি। আমরা তাদের কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছি, আগামী রোববার পেমেন্ট করার ক্ষেত্রে ডলারের রেট ১২৫ টাকা দিতে হবে, কারণ বেশি দামে ডলার কিনে কম দামে বিক্রির সুযোগ নেই।”
রাষ্ট্রায়ত্ত বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের পেমেন্ট ওভারডিউ হওয়ার কারণে এখন পেমেন্টের চাপ পড়ছে মন্তব্য করে এই কর্মকর্তা আরও বলেন, “রাষ্ট্রায়ত্ত যেসব প্রতিষ্ঠান আমদানি করে, আগে তাদের একাউন্টে পর্যাপ্ত টাকা ছিল না। ফলে তারা ডলার কিনতে পারেনি। বর্তমানে গত কয়েকদিন আগে, এসব একাউন্টে কিছু টাকা জমা হওয়ায় তারা পেমেন্টগুলো করে দিতে চাইছে। এসব কারণে আমাদের চাহিদা কিছুটা বেড়েছে।”
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঠিকমতো তদারকি না করায় বেসরকারি একটি বা দুইটি ব্যাংক ডলারের দাম বাড়ানোর পেছনে মূল ভূমিকা রাখছে বলে অভিযোগ করেন এই কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, “আইএমএফ কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ডলারের রেট নির্ধারণে ক্রলিং পেগ বাস্তবায়নের জন্য চাপ দিচ্ছে। সেখান থেকেই আমাদের ধারণা, আগামীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মার্কেট ওপেন করে দিয়ে ক্রলিং পেগ পুরোদমে চালু করতে পারে। ফলে ডলারের দাম বাড়তে পারে।”
“এ শঙ্কায় গ্রাহকেরা তাদের পেমেন্টগুলো ক্লিয়ার করে দিতে চাচ্ছেন। একইসঙ্গে বিদেশি বড় এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোও এ সুযোগে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে,” যোগ করেন তিনি।
রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে
চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ফর্মাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ ২৬.৪৪ শতাংশ বেড়েছে। গত অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ৮.৮১ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরে সেটি বেড়ে হয়েছে ১১.১৪ বিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আগের অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে দেশের ব্যাংকখাতে রেমিট্যান্স বেড়েছে ২.৩৪ বিলিয়ন ডলার— যার পুরোটাই নিয়ে নিচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো।
অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বেশিরভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্সের ডলার সংগ্রহে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে টেক্কা দিচ্ছে।
অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে অগ্রণী, জনতা, রূপালী, সোনালী ও কৃষি— এই ৫ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক রেমিট্যান্স পেয়েছে ৩.৪২ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্স পেয়েছিল ১.০৮ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ,ব্যাংকগুলোর রেমিট্যান্স বেড়েছে প্রায় ২১৭ শতাংশ বা ২.৩৪ বিলিয়ন ডলার।
এসব ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৩৪৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে রূপালী ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত বাকি ব্যাংকগুলোও শতভাগের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে চলতি অর্থবছরে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অগাস্টের শুরুর দিকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নস্ট্রো অ্যাকাউন্টে ৬.০৯ বিলিয়ন জমা ছিল। অক্টোবর শেষে সেটি ২৪ শতাংশ কমে ৪.৬২ বিলিয়নে নেমে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিপিএম৬ অনুসারে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৯.২ বিলিয়ন ডলার ছিল। গত ৩০ অক্টোবর যা ছিল ১৯.৮৭ বিলিয়ন ডলার।
বিপিএম৬ হলো, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাবের আন্তর্জাতিক মান। আইএমএফের নিয়ম অনুযায়ী, এই পদ্ধতি ব্যবহার করেই দেশগুলোকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাব করতে হয়।
Leave a Reply