বিশেষ প্রতিবেদন :
গত বছর আলু ও পেঁয়াজের দাম বেশি থাকায় কৃষকরা এবার এ দুটি পণ্যের আবাদ বাড়িয়েছেন। কিন্তু এবার তারা আশানুরূপ দাম পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন এসব কৃষি পণ্য উৎপাদক ও বিপণন সংশ্লিষ্টরা। প্রায় একই চিত্র ডিমের ক্ষেত্রেও। খামারিরা বেশি দামের আশায় ডিমের উৎপাদনও বাড়িয়েছেন। কিন্তু বাজারের দামে এর প্রতিফলন দেখা যায়নি।
অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের পণ্যমূল্য বিশ্লেষণ করে এটা দেখা যাচ্ছে যে, উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়ার কারণে নিত্যপণ্যের দাম কমে। আবার চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ঘাটতি হলে দাম বেড়ে যায়। নিত্যপণ্যের বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, গত বছর এসব নিত্য পণ্যের দাম বেশি ছিল। কিন্তু কোনো অনুসন্ধান ছাড়াই সরকারের পক্ষ থেকে দাম বাড়ার জন্য তাত্ক্ষণিকভাবে তথাকথিত সিন্ডিকেটকে দায়ী করেছিলেন। এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে কৃষক ও খামারিরা জানিয়েছেন যে, গরম আবহাওয়া ও বন্যার কারণে উৎপাদন কমে যাওয়ায় বাজারে সরবরাহ কমায় দাম বেড়েছে। তাদের মতে, এটা স্পষ্ট যে, সরবরাহ তারতম্যের ভিত্তিতে দামের কমা বা বাড়া নির্ভর করে।
কিছুদিন আগে রাজশাহী অঞ্চলের বেশ কয়েক জন কৃষকের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তারা জানান, গত বছর এসব কৃষিপণ্যে বেশি দাম পেয়ে এবারও তারা বাড়তি উৎপাদনে উত্সাহিত হয়েছিলেন। কিন্তু পণ্য সংরক্ষণসংকটে বিক্রির চাপ বাড়ার কারণে ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না।
সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট আমিনুল ইসলাম গত ছয় বছর ধরে নিজ এলাকা নাটোরের বাগাতিপাড়ার কৃষিখামার করছেন। গত বছরের মতো বেশি দাম পাওয়ার আশায় নিজের জমির সঙ্গে আরও ১০ বিঘায় পেঁয়াজ, আলু ও রসুন বুনেছিলেন। আমিনুল ইসলাম ইত্তেফাককে জানান, আগের বছরের চেয়ে পাঁচ বিঘা বেশি জমিতে পেঁয়াজ করেছি, কিন্তু আশানুরূপ ফলন ও দাম কোনোটাই পাওয়া যায়নি। উৎপাদন ও সরবরাহ বেশি হওয়ার কারণে এবার পেঁয়াজের দাম ব্যাপক কমেছে। আগের মৌসুমে বিঘাপ্রতি পেঁয়াজ চাষে গড়ে ১ লাখ টাকার বেশি লাভ হতো। এবার লাভ করা কঠিন হবে। তবে অচিরেই উৎপাদিত ফসলের দাম বাড়বে বলে তিনি আশা করছেন।
রাজশাহীর মোহনপুরের কৃষক মো. ওবায়দুল ইসলামও এ অঞ্চলের অন্যান্য কৃষকের মতো আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ জমিতে আলু আবাদ করেছেন। ইত্তেফাককে তিনি জানান, কৃষক ভেদে প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচ ২০ থেকে ২২ টাকা হলেও এবার বাজারদর কম। অনেক কৃষক আট টাকা দরেও আলু বিক্রি করেছেন। কোল্ড স্টোরেজে স্থানসংকুলান না হওয়ায় নিরুপায় হয়ে অনেক কৃষক আলু বাড়িতে স্তূপ করে রেখেছেন।
মোহনপুরের ভিমপাড়ার খামারি মো. আলম শেখের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, গত বছর প্রতি কেজি আলুর গড় উৎপাদন খরচ ছিল ১১ থেকে ১২ টাকা। আর বিক্রি করেছি গড়ে ৩০ টাকা দরে। মজুত করা আলু ৪৮ থেকে ৫০ টাকা দরেও বিক্রি করেছি। এবারও ভালো দামের আশায় উৎপাদন বাড়িয়েছি। কিন্তু এবার দাম না পাওয়ায় আবার ভবিষ্যতে আলুর উৎপাদনে ভাটা পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
পণ্যের বাজারদর বাড়া বা কমার কারণ সম্পর্কে বেশ কয়েক জন কৃষকের সঙ্গে আলাপ করলে তারা জানান, মূলত উৎপাদন ও সরবরাহ-ভাটায় কৃষিপণ্যের দাম বাড়ে। আবার উৎপাদন বেশি হলে দাম কমে যায়। কারণ দেশের হাজার হাজার কৃষক এক হয়ে দরকষাকষি করতেও পারে না। তারা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, কৃষিপণ্যের বাজারে সিন্ডিকেট শব্দটি একেবারেই হাস্যকর। এর ধরনের অভিযোগ সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
কৃষিপণ্যের সাম্প্রতিক দরপতন সম্পর্কে কাজী ফার্মসের পরিচালক কাজী জাহিন হাসান ইত্তেফাককে বলেন, গত বছর বন্যার কারণে অনেক কৃষিপণ্যের ঘাটতি দেখা দিয়েছিল, ফলে দামও বেড়েছিল। আগের বছর ভালো দর পেয়ে উত্সাহিত কৃষকরা এবার বেশি উৎপাদন করেছেন। এতে পণ্যের দাম কমে গেছে। এ ধরনের দাম বিপর্যয়ের কারণে ভবিষ্যতে আবার উৎপাদন কমে যাওয়ার ইঙ্গিতও তিনি দিয়েছেন।
কাজী জাহিন হাসানের মতে, সরকারি সংস্থাগুলো দুর্ভাগ্যবশত বুঝতে পারে না যে, সরবরাহ ও চাহিদা কীভাবে কাজ করে। যখন দাম বেশি ছিল, তখন অনেক সরকারি কর্মকর্তা ডিম, পেঁয়াজ ও আলুর উৎপাদকদের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট করার অভিযোগ তুলেছিলেন। কিন্তু দাম যদি সিন্ডিকেট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে এখন দাম কেন কমেছে? পণ্যের বাজারদর যে আসলে সরবরাহ ও চাহিদা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তা পুরোপুরি স্পষ্ট।
রাজশাহীর পবার কাটাখালীর এলাকার পোল্ট্রি খামারি মো. সাইফুল ইসলামের খামারে প্রতিদিন ডিমের উৎপাদন হয় ১০ হাজার। তিনি জানান, শীত মৌসুম ও রোজার কারণে প্রতি বছরের মতো এবারও বাজারে ডিমের চাহিদা কম হওয়ায় ডিমের দাম উৎপাদন খরচের নিচে নেমে গেছে। ডিম সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় খরচের তুলনায় দাম কম হলেও খামারিরা ডিম বিক্রি করতে বাধ্য হন। এতে করে অনেক খামারি পোল্ট্রি ব্যবসা ছেড়ে দেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
ডিমের বাজারদর প্রসঙ্গে রাজশাহীর পবার মেসলেমের মোড় এলাকার ডিম পাইকার আনোয়ার হোসেন জানান, সাম্প্রতিক সময়ে ডিমের উৎপাদন কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বেড়েছে। গড়ে প্রতিদিন ৫০ হাজার ডিম সরবরাহকারী আনোয়ার বলেন, বাজারদর কমে যাওয়ায় খামারিদের উৎপাদন খরচ তুলে আনাও চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত বছর অক্টোবর-নভেম্বর যখন নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গিয়েছিল, তখনকার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রূশাদ ফরিদী বলেন, বন্যায় কৃষিখামারে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে বাজারে পণ্য সরবরাহ কমে যায়। ফলে অর্থনীতির মৌলিক নীতি অনুসারে দাম বাড়ে। একই ভাবে মে মাস থেকে উচ্চ তাপপ্রবাহ এবং পরে বন্যার কারণে পোল্ট্রি খাতেও বিরূপ প্রভাব পড়ে। যার ফলে বাজারে সরবরাহ ঘাটতি দেখা দেয় এবং অনিবার্যভাবে দামও বাড়ে।
Leave a Reply