মতামত:
১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ধরিত্রী সম্মেলনে প্রতি বছর ৮ জুন বিশ্ব সমুদ্র দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সে বছরই প্রথমবারের মতো দিবসটি পালন করা হয়। এরপর ২০০৮ সালে জাতিসংঘ বিশ্ব সমুদ্র দিবস পালনের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। এ বছর বিশ্ব সমুদ্র দিবসের থিম নির্ধারণ করা হয়েছে, Planet Ocean : Tides are Changing। বস্তুত এ গ্রহটাই তো সমুদ্রের। কারণ পৃথিবীর তিন ভাগ জল এবং এক ভাগ জুড়ে স্থল রয়েছে। সে হিসেবে পানির পরিমাণ অধিক। আর ঢেউ পরিবর্তন বলতে বোঝাচ্ছে যে দিন বদল হচ্ছে। অর্থাৎ মানুষ এখন সচেতন হচ্ছে। মানুষ সমুদ্রকে নতুন রূপে আবিষ্কার করছে। মানুষ এখন আর আগের মতো নেই, আমরা এখন সমুদ্রের দিকে অধিক ঝুঁকে পড়েছি। সমুদ্রের সম্ভাবনার অগণিত দিক রয়েছে, বলা হয়ে থাকে ২৬টির বেশি খাত রয়েছে, যেগুলো সমুদ্রভিত্তিক অর্থনীতি গড়তে সহায়তা করে। সেগুলোকে ব্লু ইকোনমির প্রধান সেক্টর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মৎস্যসম্পদ একটি বড় সম্পদ, আমাদের প্রচুর পরিমাণ মৎস্যসম্পদ আছে এবং বাংলাদেশ ফিশারিজে অনেক দূর এগিয়ে রয়েছে। আমরা মাছ রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করছি। এটি আমাদের অর্থনীতিতে বড় একটি অবদান রাখছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এর বাইরে বন্দর এবং নৌ পরিবহনের কথা বলা যায়, আমাদের চট্টগ্রাম বন্দর অর্থনীতিতে খুব ভালো অবদান রাখছে। কারণ বৃহৎ পরিমাণে ট্রানজেকশন হচ্ছে, বিদেশী জাহাজ আসছে। এ বন্দরের মাধ্যমে আমরা পণ্য আমদানি-রফতানি করছি। এছাড়া মোংলা সমুদ্রবন্দর আছে, নতুন যে সমুদ্রবন্দর হয়েছে পায়রা—সেটি ভূমিকা রাখবে। মাতারবাড়ীর দিকে গভীর সমুদ্রবন্দরের যে কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটিও অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা পালন করবে। শুধু সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করেই পৃথিবীতে অনেক দেশ তাদের অর্থনীতিতে উন্নতি করতে পেরেছে। সমুদ্রবন্দর শুধু নিজেদের মালামালের জন্য নয়, অন্যরাও সেখানে ট্রানজিট নেয়। এবং যত জাহাজ আসবে তত বেশি সে দেশের উপার্জন হবে। বিদেশী জাহাজগুলো থেকেও প্রতি বছর অনেক উপার্জন হয়। এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দর ভূমিকা রাখছে। মোংলা সমুদ্রবন্দরও ভালো করছে, সব সমুদ্রবন্দর যদি আমরা সক্রিয় করতে পারি, বড় জাহাজ যদি সেখানে প্রবেশ করতে পারে, তাহলে সেগুলো দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে। এরপর জাহাজ নির্মাণ এবং জাহাজ ভাঙা শিল্প রয়েছে। সীতাকুণ্ডের দিকে অনেক শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড আছে, এগুলোয় শিপ রিসাইক্লিংয়ের কাজ হয়। এখানে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, কারণ জাহাজ যখন ভাঙা হয়, পরিবেশগত বিপত্তি ও স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকে। শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে আরো ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন রয়েছে। সেখানে বেশ কয়েকটি শিপ রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রি যেমন পিএইচপি খুব ভালো করছে, তারা গ্রিন শিপ রিসাইক্লিং করছে। একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে যে, পৃথিবীতে এ সময়ে অনেক জাহাজ মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে এবং মেয়াদ উত্তীর্ণের পথে রয়েছে। প্রযুক্তিও পরিবর্তন হচ্ছে, পুরনো প্রযুক্তির যে জাহাজগুলো সেগুলো তো ভাঙতে এবং রিসাইকেল করতে হবে। সে ব্রেকিং ইয়ার্ডের ব্যবস্থা পৃথিবীর খুব কম জায়গায় আছে, বাংলাদেশ সে হিসেবে ভালো অবস্থানে রয়েছে। যদি আমরা এটাকে সঠিক, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব উপায়ে করতে পারি, তাহলে বাংলাদেশের এ খাতে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। সেখান থেকে অর্থনীতিতে এ খাত এখনো ভালো ভূমিকা রেখে আসছে, এটাকে আরো ভালোভাবে করা সম্ভব হবে। জাহাজ নির্মাণের কথা যদি বলি—একটা সময় ছিল যখন আমরা নৌবাহিনী অথবা অন্যান্য মার্চেন্ট জাহাজের জন্য চীন এবং অন্য দেশগুলো থেকে জাহাজ কিনতাম। সে দৃশ্যটা ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে। বাংলাদেশের যে দুটো সরকারি শিপইয়ার্ড, বিশেষ করে খুলনা ও নারায়ণগঞ্জের বেশকিছু জাহাজ গত কয়েক বছরে উদ্বোধন হয়েছে, যেগুলো নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড ব্যবহার করে। এ শিপগুলো নিজেদের বানানো, যদিও ইঞ্জিন এবং অন্যান্য জিনিস বাইরে থেকে কিনে এখানে অ্যাসেম্বল হচ্ছে। তার পরও অন্তত হালটা তৈরি হচ্ছে, শ্রমটা নিজেদের হচ্ছে। এটি দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। এটাকে যদি আরো গোছানো যায় এবং পরিচালনা সুন্দরভাবে করা যায়, আরো ভূমিকা রাখবে।
পৃথিবীতে অনেক দেশ আছে যারা শুধু আন্তর্জাতিক পর্যটনের ওপর ভিত্তি করে উন্নয়ন করেছে। আমাদের এখানে আমরা আন্তর্জাতিক পর্যটনকে অত বেশি আকৃষ্ট করতে পারিনি। যদিও আমাদের বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারসহ কুয়াকাটা, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ আছে। এখানে পরিবেশগত দূষণ বড় কারণ হলেও একে পরিবেশবান্ধব করতে হবে, ইকো-ট্যুরিজম করতে হবে। এটাকে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে শুধু পর্যটনের মধ্য দিয়েই একটা দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব। এক্ষেত্রে সমুদ্রের দিকে আমাদের সম্ভাবনাটা অনেক বেশি।
সমুদ্রে অনেক সম্পদ রয়েছে, উদাহরণ হিসেবে উদ্ভিদ এবং প্রাণীর কথা বলা যায়। সেখান থেকে ওষুধ তৈরি করা যায়। বিভিন্ন ধরনের মূল্যবান ব্যবহার্য পণ্য তৈরি করা যায়, যেগুলো স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। সে শিল্পটা আমাদের এখানে তৈরি হয়নি। তারপর কোন কোন প্রজাতি আমাদের আহরণ করা দরকার, কোনগুলো চাষ করা দরকার, সে গবেষণা চলছে, এ গবেষণা আরো বেগবান করতে হবে। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে, বিদেশে আমাদের ওষুধ রফতানি করা হয়। এখন সমুদ্রভিত্তিক এসব ক্ষেত্রে যদি আমরা মনোযোগ দিই, তাহলে ওষুধ শিল্পে নিজের দেশের চাহিদা পূরণ হবে, নতুন করে সেটি আরো ভালো শিল্পে পরিণত হবে এবং বিশ্বে আমরা রফতানি করতে পারব।
আমি যে খাতগুলোর কথা বললাম, আরো অন্য খাতের সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য সমুদ্রে গবেষণা খুব দরকার। বাংলাদেশে সমুদ্র নিয়ে গবেষণার জন্য কক্সবাজারে একটি সরকারি ইনস্টিটিউট আছে, বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফি রিসার্চ ইনস্টিটিউট, যেটাকে সংক্ষেপে ‘বোরি’ বলা হয়। খুব বেশি দিন হয়নি প্রতিষ্ঠানটির, এটির সক্ষমতার জন্য সরকার একটি প্রকল্প এরই মধ্যে নিয়েছে। সরকার এক্ষেত্রে মনোযোগ নিবদ্ধ করেছে। আমি বিশ্বাস করি, সরকার এতে সফল হবে। এটিকে যদি সঠিকভাবে পরিচালনা করা যায়, তাহলে অবশ্যই সমুদ্র গবেষণায় কাজে লাগাতে পারব। বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে সমুদ্রবিজ্ঞান নিয়ে শিক্ষা ও গবেষণা হয়। তার মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি আছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আছে, আরো বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ খোলা হয়েছে। আমি মনে করি, উচ্চশিক্ষার জন্য এ প্রতিষ্ঠানগুলোই যথেষ্ট। প্রচুর শিক্ষার্থী সমুদ্রবিজ্ঞানে জ্ঞান আহরণ করছে। এখন তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা দরকার। কারণ একাডেমিক এবং ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে যে সংযোগ, সেটি অনেক বাড়াতে হবে, যা আমরা খুব বেশি কার্যকর করতে পারিনি। যে কারণে আমরা এক ধরনের সিলেবাস বা কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছি। কিন্তু যারা এ ফিল্ডে ব্যবহারিকভাবে চাকরি করবে, তারা সে কারিকুলামের কতটুকু প্রয়োগ করতে পারবে তা বিবেচ্য বিষয়। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, সমুদ্রসম্পদের ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের শিক্ষাজীবনে অর্জিত জ্ঞানের ব্যবহার প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা, স্টেকহোল্ডার, বেসরকারি সংস্থাগুলো যদি আমাদের সঙ্গে এগিয়ে আসত, তাহলে আমরা সেভাবে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলতে পারতাম। তাহলে তারা সরাসরি অবদান রাখতে পারত। সে সংযোগটা আমাদের আরো বাড়াতে হবে। কারণ ব্যবহারিক ক্ষেত্র অনুযায়ী পড়াশোনা দরকার। আমি মনে করি, আমাদের শিক্ষার্থীরা মেধাবী, তারা সেটির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের চাকরির সুযোগ আরো বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসসহ (বিসিএস) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সমুদ্রবিজ্ঞান থেকে যারা যাচ্ছে তাদের যেন কাজে লাগানো হয়। এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তবে আমাদের ব্লু ইকোনমিকে কাজে লাগানোর যে চ্যালেঞ্জ, ২০১২ থেকে ২০১৪ সালে যথাক্রমে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্র বিজয় হলো, এরপর তো অনেক বছর হয়ে গেল! এখন আমরা নতুন কি করতে পারলাম? সে বিষয়গুলো নিয়ে যদি বলি, একেবারে হতাশার কিছু নেই, মৌলিক গবেষণা তো সবাই করে যাচ্ছেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, গবেষণার জন্য ডেডিকেটেড কোনো জাহাজ নেই। যে জাহাজ দিয়ে আমরা সমুদ্রে গবেষণা করতে যাব। বাংলাদেশে এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে, কিন্তু সে গবেষণাগুলো যথার্থভাবে করতে পারছে না। সমুদ্রে যাওয়া অনেক ব্যয়বহুল, আমরা গত বছর নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড ও বন্দরের সাহায্য নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে বেশকিছু এক্সপেডিশন করেছি। বেশকিছু ডাটা সংগ্রহ করেছি, সেগুলো নিয়ে গবেষণা চলছে। সেক্ষেত্রে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যেমন ডেডিকেটেড জাহাজ ও যন্ত্রপাতি নেই। সমুদ্রে ডাটা সংগ্রহ করার উপকরণগুলো অনেক ব্যয়বহুল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে স্বল্প বাজেট দেয়া হয়, তা দিয়ে সেগুলো কেনার সামর্থ্য নেই। দেখা যাচ্ছে যে সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের জন্য যে বাজেট, অন্য একটা বিভাগ যাদের এ ধরনের খুব ব্যয়বহুল উপকরণের দরকার নেই, তাদের বাজেটও একই। সবার জন্য একই বাজেট থাকলে সেটা তো আসলে কঠিন। এ ধরনের বিষয়কে বিকশিত করার জন্য অনেক বড় বাজেট দরকার। অনেক যন্ত্রপাতি কেনা দরকার। এবং অবশ্যই বাংলাদেশে সমুদ্রে গবেষণার জন্য ওশানোগ্রাফি রিসার্চ ভেসেল কেনা দরকার। যেগুলো না হলে আমরা সমুদ্রকে সেভাবে কাজে লাগাতে পারব না। আমরা আশা করি, সময়ের চাহিদা অনুযায়ী সমুদ্রে গবেষণার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যথোপযুক্ত ভূমিকা গ্রহণ করা হবে। পরিশেষে বিশ্ব সমুদ্র দিবস সফল হোক, এ প্রত্যাশা করছি।
ড. কে এম আজম চৌধুরী: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ওশান গভর্ন্যান্সের পরিচালক, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর লে. কমান্ডার (অব.)
Leave a Reply