বিশেষ সংবাদ:
অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় সাবেক পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় সচিব প্রশান্ত কুমার রায়ের জামিনের আবেদন নাকচ করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
রবিবার ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আস-সামছ জগলুল হোসেন এই আদেশ দেন। এদিন প্রশান্ত কুমার আদালতে আত্মসমর্পণ করে আইনজীবীর মাধ্যমে জামিন চেয়ে আবেদন করেছিলেন।
দুদকের মামলায় ১৯৮৬ সালের বিসিএসের এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সোয়া কোটি টাকার সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি একটি আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থীও হয়েছিলেন।
এই মামলায় গত বছরের ১৮ জুলাই হাইকোর্ট ছয় সপ্তাহের আগাম জামিন দেয়। এর ছয় সপ্তাহ পর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালত আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়। প্রশান্ত কুমার রায় যথাসময়ে আত্মসমর্পণ করে জামিন চান। তৎকালীন জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ তার জামিনের আবেদন নিষ্পত্তি না করে তা ঝুলিয়ে রাখেন।
রবিবার (আজ) ওই আবেদনের ওপর শুনানি হয়। শুনানি শেষে আদালত জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়।
জামিন আবেদনের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন দুদকের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মীর আহমেদ আলী সালাম।
২০২৩ সালের ৫ জুন দুদকের উপ-পরিচালক মো. মশিউর রহমান ‘একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের’ সাবেক পরিচালক প্রশান্ত কুমারের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত ১ কোটি ২৫ লাখ ৪০ হাজার ২৪৭ টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করেন।
প্রশান্ত কুমারের বাড়ি খুলনার বাটিয়াঘাটা থানার গোপ্তমারী গ্রামে। ঢাকায় থাকেন মোহাম্মদপুরের কাদিরাবাদ হাউজিং সোসাইটির ৫ নম্বর রোডের ৩ নম্বর বাড়িতে।
মামলার এজাহারে যা বলা হয়েছে
প্রশান্ত কুমার রায় ও তার ওপর নির্ভরশীলদের নামে কয়েকটি ব্যাংকের ১২টি শাখায় খোলা হিসাব নম্বরে বিভিন্ন সময়ে ১৩ কোটি ২৪ লাখ ৩ হাজার ৮৫০ টাকা জমা এবং ১২ কোটি ৯৮ লাখ ৭২ হাজার ১৮৩ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে এই লেনদেন অস্বাভাবিক ও অসঙ্গতিপূর্ণ। আসামির দুই মেয়ে অস্ট্রেলিয়া পড়াশোনা করেন। তাদের খরচ মেটানোর কথা বলে প্রশান্ত কুমার ব্যাংকিং চ্যানেলে মোট ৩৫ লাখ টাকা পাঠানোর পাশাপাশি হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল অর্থ সেখানে পাচার করেন। আসামির ভাগ্নে মনোজ কুমার ৩৫ বছর ধরে স্থায়ীভাবে বিদেশে বসবাস করছেন। তার নামে দেশে থাকা ভূমির আমমোক্তার নিযুক্ত হয়ে পর্যায়ক্রমে ওই ভূমি ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা বিক্রি করে তা আয় দেখিয়ে অবৈধ সম্পদ বৈধ করার অপপ্রয়াস চালান প্রশান্ত। জমি বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ থেকে ৫০ লাখ টাকা তিনি ভাগ্নে মনোজ কুমারকে হুন্ডির মাধ্যমে দেন, যা দেশের প্রচলিত আইনের পরিপন্থি।
দুদকের অনুসন্ধানে প্রশান্ত কুমারের নামে ১ কোটি ৩৪ লাখ ৯২ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রশান্ত কুমার ২০২০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি কমিশনে সম্পদ বিবরণী পেশ করেন। এতে জমি, প্লট কেনাসহ ১ কোটি ৬৪ লাখ ৮০ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদ দেখানো হয়। উপহারের স্বর্ণালংকার ছাড়াও ব্যাংকে জমানো টাকা, আসবাবপত্র, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, বিনিয়োগ, হাতে নগদ ও অন্যান্য খাতে মোট ১ কোটি ১৩ লাখ ৮৭ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদের হিসাব দেওয়া হয়। অর্থাৎ তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ২ কোটি ৭৮ লাখ ৬৭ হাজার টাকার। তবে তার সম্পদ বিরবণী যাচাই ও অনুসন্ধানে পিতার কাছ থেকে পাওয়া সম্পদ ছাড়া পাকা ভবন নির্মাণ, জমি, প্লট-ফ্ল্যাট ক্রয়সহ বিভিন্ন খাতে ২ কোটি ৮৫ লাখ ২৯ হাজার ৮৮১ টাকার স্থাবর সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া ব্যাংকে নগদ, সঞ্চয়পত্র, এক্সক্যাভেটর (খনন যন্ত্র), আসবাবপত্র, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, হাতে নগদ অর্থসহ ১ কোটি ১৮ লাখ ৮৭ হাজার ৫৪০ টাকার অস্থাবর সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়। অর্থাৎ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ৪ কোটি ৪ লাখ ১৭ হাজার টাকার। এ হিসাবে তিনি ১ কোটি ২৫ লাখ ৪৯ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, তার পারিবারিক খরচের হিসাব পাওয়া যায় ২ কোটি ৫ লাখ ৭৮ হাজার টাকার। এই হিসাব অনুযায়ী তার মোট অর্জিত অর্থসম্পদ ৬ কোটি ৯ লাখ ৯৫ হাজার টাকার। তার ২০২০-২১ অর্থবছরের আয়কর নথিতে ১ কোটি ৮৬ লাখ ৯৬ হাজার ৬৭১ টাকার নিট সম্পদ উল্লেখ করা হয়েছে। বেতন-ভাতা, ব্যাংক সুদ, কৃষি থেকে আয়, কর অব্যাহতি ও করমুক্ত আয়সহ সর্বমোট ৪ কোটি ৭৫ লাখ ৩ হাজার ২৮৭ টাকার গ্রহণযোগ্য আয়ের তথ্য পাওয়া যায়। বৈধ উৎসের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ ১ কোটি ৩৪ লাখ ৯২ হাজার টাকার সম্পদ পাওয়া গেছে। এই সম্পদ ভোগদখলে রেখে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। অনুসন্ধান প্রতিবেদনে তার বিরুদ্ধে মামলা করার সুপারিশ করা হয়।
স্থাবর সম্পদ
প্রশান্ত কুমার রায়ের স্থাবর সম্পদ যাচাই করে দেখা গেছে, খুলনার বটিয়াঘাটায় ৫.২১ একর জমির একাংশে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে দোতলা ভবন নির্মাণ করেছেন। এছাড়া বটিয়াঘাটায় ৫০ শতাংশ জমি দেড় কোটি টাকায় কিনেছেন। জেলার পাইকগাছায় ১.৭২ একর জমি আছে। ঢাকার সাভার উপজেলায় ২ লাখ টাকা মূল্যের ৮ শতাংশ জমি আছে। ঢাকার মোহাম্মদপুরে কাদেরাবাদ হাউজিংয়ে ১০৭০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট আছে, যার মূল্য ৪০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। মোহাম্মদপুরের পূর্ব জাফরাবাদে ১২০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট আছে, যার মূল্য ৫০ লাখ টাকা। গ্রিন রোডে গ্রিন সুপারমার্কেটের তৃতীয় তলায় ৩০০ বর্গফুটের একটি কক্ষ ১১ লাখ টাকায় কিনেছেন।
অস্থাবর সম্পদ
প্রশান্ত কুমার ২০১৩ সালে ২৩ লাখ টাকায় একটি গাড়ি কিনেছেন। ২০১৮ সালে ১৬ লাখ টাকায় একটি এক্সক্যাভেটর (খননযন্ত্র) কেনেন। সোনালী ব্যাংকের ঢাকার কারওয়ান বাজার শাখার হিসাবে ১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা, এনবিএল ব্যাংকের ঢাকায় দিলকুশা শাখায় ৫ লাখ ১০ হাজার টাকা আছে। এছাড়া অন্যান্য ব্যাংক হিসাবের তথ্য পাওয়া গেছে।
অর্থ পাচারের অভিযোগ
দুদকের অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রশান্ত কুমার খুলনার বটিয়াঘাটায় ভাগ্নে মনোজ কুমার বিশ্বাসের কাছ থেকে ৫.৮০ একর জমির মালিক হন পাওয়ার অব অ্যাটর্নি মূলে। পরে স্থানীয় নুরুল আলমের কাছ থেকে বায়না চুক্তি করে ২৫ লাখ টাকা গ্রহণ করেন। এরপর জমির একটি অংশ ১ কোটি ৫৫ লাখ ৭০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। এর মধ্য থেকে ৫০ লাখ টাকা মনোজ কুমারকে দিয়েছেন। অথচ মনোজ কুমার ৩০-৩৫ বছর ধরে ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তিনি একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। বিদেশি ব্যক্তির কাছ থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি গ্রহণ এবং তাকে ৫০ লাখ টাকা দেওয়া মানি লন্ডারিং অপরাধ।
আগেও দুদকে অভিযোগ
প্রশান্ত কুমার রায় ২০১৬ সালের ১৪ মার্চ ভারপ্রাপ্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। ২০১৭ সালের ১৪ এপ্রিল তিনি অবসরে যান। এর আগেও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ দেওয়া হয় দুদকে। ২০১৫ সালে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুদক থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি দেওয়া হলেও পরবর্তী সময়ে তাকে সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। পরে তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকে আরও একটি অভিযোগ দেওয়া হয়। এই অভিযোগটি অনুসন্ধান করে কমিশনে মামলার সুপারিশ করে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে খুলনা-১ আসন থেকে স্বতন্ত্র পদে নির্বাচন করেছিলেন সাবেক এই সচিব। ঈগল প্রতীকে তিনি ভোট পান ৫ হাজার ২৬২ ভোট। এই আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী ননী গোপাল মণ্ডল এক লাখ ৪২ হাজার ৫১৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন।
Leave a Reply