বিশেষ সংবাদ:
চট্টগ্রামে ৪৮ ঘণ্টার গণপরিবহন ধর্মঘট ১২ ঘণ্টার ব্যবধানে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন বৃহত্তর চট্টগ্রাম গণপরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। গতকাল রোববার বিকেলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভার পর এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পরিষদের নেতারা।
এরআগে সকাল ৬টা থেকে গণপরিবহন ধর্মঘট শুরু করে বৃহত্তর চট্টগ্রাম গণপরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। ৪ দফা দাবিতে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় এ ধর্মঘট পালন করতে দেখা যায় পরিবহন শ্রমিক ও নেতাদের। এতে তৈরি হয় তীব্র ভোগান্তি। নগরী থেকে জেলা-উপজেলায় গণপরিবহণ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। একইভাবে নগরীতে ঢুকতে পারেনি জেলা-উপজেলা থেকে কোনো গণপরিবহণও। একই পরিস্থিতি ছিল দূরপাল্লার গণপরিবহণেরও। ফলে সড়ক পথে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে চট্টগ্রাম অঞ্চল।
তীব্র গরমের মধ্যে পায়ে হেঁটে হাজারো মানুষকে গন্তব্যে ছুটতে দেখা গেছে। আবার হাজারো মানুষকে দেখা গেছে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে। তবে বেশি বিপাকে পড়ে নারী-শিশুরা। স্কুল খোলার দিন ধর্মঘট হওয়ায় বেশি ভোগান্তিতে পড়ে শিক্ষার্থীরা। রিকশা, ভ্যান ও ট্রাকে ছড়ে অনেকে গন্তব্যে পৌঁছে। এতে দ্বিগুন/তিনগুন ভাড়া গুনতে হয় তাদের।
চট্টগ্রাম নগরীর শাহ আমানত সেতু এলাকা, বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল ও অক্সিজেন মোড় থেকে বিভিন্ন জেলা-উপজেলাগামী বাস ছেড়ে যায়নি। নগরীতেও গণপরিবহনের সংখ্যা কম ছিল। তবে পিকআপ, সিএনজি, টেম্পো ও পণ্য পরিবহন মালিক-চালক ঐক্য পরিষদ এবং বাংলাদেশ অটোরিকশা হালকা যান পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন এ ধর্মঘট প্রত্যাখ্যান করায় চলেছে কিছু যানবাহন। এভাবে পার হয় ধর্মঘটের ১২ ঘণ্টা।
ওইদিন বিকেল তিনটার দিকে ধর্মঘট প্রত্যাহারের বিষয়ে পরিবহন শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর বৈঠক শুরু হয়। এ সময় সংগঠনের পক্ষ থেকে কাপ্তাই-চট্টগ্রাম সড়কে গাড়ি চলাচলে নিরাপত্তা প্রদান, গাড়ি পোড়ানোর বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে ক্ষতিপূরণ, অবৈধ গাড়ির বিষয়ে ব্যবস্থা, শ্রমিকের ওপর অকারণে মামলা না করা— এই চারটি দাবি তোলা হয়।
চট্টগ্রাম গণপরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক মঞ্জুরুল আলম চৌধুরী বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে ধর্মঘট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের কথা জানান। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম জেলা প্রসাশনের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে গণপরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তিনি পরিবহন সংগঠনের পক্ষ থেকে চারটি দাবির কথা জানান। দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক।
চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কে পুলিশ পাহারায় গাড়ি চলার কথা জানিয়ে গণপরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব মোহাম্মদ মুছা বলেন, আপাতত আমরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছি। কিন্তু আমরা চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কে নিরাপত্তা চাই। বৈঠকে এখন থেকে কাপ্তাই সড়কে পুলিশ পাহারা দেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করা হয়েছে। ‘যদি সড়কে আমাদের আর কোনো গাড়িতে হামলা চালানো হয়; তাহলে পুনরায় আবার ধর্মঘট ডাকা হবে’ ‘ তবে হুঁশিয়ার জানিয়ে তিনি বলেন,।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবির মধ্যে যে তিনটি প্রশাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সেগুলোর বিষয়ে ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সড়ক সংস্কার, নিহত-আহত শিক্ষার্থীদের ক্ষতিপূরণসহ সড়কের শৃঙ্খলার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে, মামলা প্রত্যাহারের সুযোগ নেই। তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
‘গাড়ি পোড়ানোর বিষয়ে যদি মামলা হয়ে থাকে সেটিও আইনি প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা হবে। এছাড়া সড়কে কোনো চাঁদাবাজি করা যাবে না। নিরাপত্তার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি জেলা প্রশাসনের সহায়তাও থাকবে’ -যোগ করেন জেলা প্রশাসক।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের সভাপতিত্বে বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ কে এম গোলাম মোর্শেদ খান, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রতিনিধি অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার নোবেল চাকমা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাউজান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের প্রতিনিধি, বিআরটিএর সহকারী পরিচালক রায়হানা আক্তার উর্থি প্রমুখ।
প্রসঙ্গত, গত ২২ এপ্রিল চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কে বাসের ধাক্কায় চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) দুই শিক্ষার্থী নিহত হন। এতে আহত হন আরও এক শিক্ষার্থী। ওই ঘটনার প্রতিবাদে টানা চারদিন সড়ক অবরোধ করেন চুয়েট শিক্ষার্থীরা। এ সময় ৩টি বাস পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে শনিবার সংবাদ সম্মেলন ডেকে রোববার সকাল ৬টা থেকে ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘট পালনের ডাক দেয় বৃহত্তর গণপরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ।
এদিকে ক্রেতা-ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী জাতীয় প্রতিষ্ঠান কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বিভিন্ন দাবিতে চট্টগ্রামে চলা ৪৮ ঘণ্টার পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে। গতকাল রোববার গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ক্যাবের নেতারা বলেছেন, গণপরিবহনের মালিক ও শ্রমিকেরা দেশের আইনের শাসনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে বারবার জনগণকে জিম্মি করছেন। বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে মানুষ হত্যা করার প্রতিবাদ মানুষ করছে। আর এতেই ধর্মঘটের নামে মানুষকে জিম্মি করা হচ্ছে। এটি বর্বরতা।
ক্যাবের বিবৃতিতে বলা হয়, গণপরিবহনের মালিক ও শ্রমিকদের সরকারের পক্ষ থেকে নানাভাবে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। এ কারণে তাঁরা এ ধরনের অবৈধ ধর্মঘট পালন করছে। সরকারও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এ ছাড়া সড়ক পরিবহন খাতে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকেরাই নীতি প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। আর খেসারত দিচ্ছে জনগণ।
Leave a Reply