বিশেষ সংবাদ:
আস্তে আস্তে জট খুলছে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের নিখোঁজ রহস্যের। ঝিনাইদহ-৪ আসনের এই এমপিকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের একটি ফ্ল্যাটে নৃশংসভাবে হত্যা করে মরদেহ গুম করা হয়েছে, যা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিশ্চিত হয়েছে। তবে এখনো মরদেহ উদ্ধার করা যায়নি। খুনের পর দুর্বৃত্তরা তার মরদেহ খণ্ড করে ট্রলি ব্যাগে নিয়ে তা গুম করেছে। ভয়াবহ এই পরিকল্পনা ভারতে বসেই হয়, যার মাস্টারমাইন্ড আনারের দীর্ঘ ৩০ বছরের ব্যবসায়িক পার্টনার আক্তারুজ্জামান শাহীন। আর পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন ছয়জনের বেশি। তাদের মধ্যে চরমপন্থি সন্ত্রাসীরাও আছেন। আছেন একজন নারীও। এই হত্যায় আনারের বন্ধু শাহীন অপরাধীদের সঙ্গে পাঁচ কোটি টাকা চুক্তি করেন। সেই অনুযায়ী কিছু টাকা সরবরাহও করেছেন। বাকিটা খুনের পর দেওয়ার কথা ছিল। কলকাতার নিউ টাউনে যে ফ্ল্যাটে সংসদ সদস্য আনারকে হত্যা করা হয়েছে, সেটি আক্তারুজ্জামান শাহীন নিজেই ভাড়া করেন। এতে তিনি আমেরিকার পাসপোর্ট ব্যবহার করেন। শাহীনের আমেরিকার নাগরিকত্ব রয়েছে এবং ঢাকার গুলশানে তার ফ্ল্যাট রয়েছে। আনোয়ারুল আজীমকে যে ফ্ল্যাটে খুন করা হয় সেটি ২৫ এপ্রিল ভাড়ার সব আনুষ্ঠানিকতা শেষের পর ৩০ এপ্রিল শাহীন নিজেই ফ্ল্যাট বুঝে নেন।
এদিকে খুনের পরিকল্পনা করে ১০ মে দেশে ফিরে আসেন প্রধান মাস্টার মাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীন। পরে বিপদ বুঝে তিনি দেশত্যাগ করেন। বর্তমানে তার অবস্থান জানতে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
জানা গেছে, এই শাহীন ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র মো. সহিদুজ্জামানের ছোট ভাই। স্বর্ণ চোরাচালানের আন্তঃদেশীয় চক্রের দ্বন্দ্বের জেরে পরিকল্পিতভাবে আজীমকে ভারতে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
এদিকে এমপি আনোয়ারুল আজীম হত্যায় বাংলাদেশে সন্দেহভাজন হিসেবে তিনজনকে আটক করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তারা হলেন- চরমপন্থি দল পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা আমানউল্লাহ আমান, মোস্তাফিজ ও ফয়সাল। তারা হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয় বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন।
আমানউল্লাহ আমান দুটি মামলায় ২০ বছর কারাগারে ছিলেন।
হত্যায় জড়িত বাকিরা হলেন- ফয়সাল, মোস্তাফিজ, সিয়াম, জিহাদ ও সিলিস্তি রহমান। তারা একাধিক চাপাতিও সংগ্রহ করে ওই ফ্ল্যাটে অবস্থান করেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিলিস্তি রহমানকে কাজে লাগিয়ে টোপ হিসেবে ওই ফ্ল্যাটে নেওয়া হতে পারে এমপি আনারকে। যদিও তিনি হত্যার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতেন না। ধারণা করা হচ্ছে, এই নারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে আছেন।
যা ঘটে ওই ফ্ল্যাটে
ডিবির হাতে আটক তিনজন এই হত্যার ঘটনায় চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। তারা জানিয়েছেন, ১৩ মে প্রথমে আজীমকে চাপাতির মুখে জিম্মি করা হয়। এসময় তার কাছে শাহীনের পাওনা টাকা পরিশোধের কথা বলা হয়। বিষয়টি নিয়ে তর্কাতর্কির একপর্যায়ে সবাই মিলে তাকে জাপটে ধরে বালিশচাপা দিয়ে হত্যা করেন। হত্যার পর আমান বিষয়টি শাহীনকে অবহিত করেন। পরে আমান দেশে চলে এলে ডিবি তাকে আটক করে। তাকে শেরেবাংলা নগর থানায় আনোয়ারুল আজীমের মেয়ের করা মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
১১ মে আজীম একাই বাংলাদেশ থেকে ভারতে যান। প্রথমে তার দীর্ঘদিনের বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাসায় ওঠেন। পরে নিখোঁজ হলে গোপাল থানায় নিখোঁজ জিডি করেন।
মরদেহ খণ্ডিত করে ট্রলিতে গুম
সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর মরদেহ কয়েক টুকরা করা হয়। সঙ্গে থাকা চাপাতি দিয়ে মরদেহ টুকরা করা হয়। এসময় বাইরে থেকে ব্লিচিং পাউডার ও একাধিক ট্রলি কিনে আনা হয়। পরে ট্রলিতে করে মরদেহ নিয়ে পৃথকভাবে দুর্বৃত্তরা ওই ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যান, যা সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়েছে। বর্তমানে ভারতের সিআইডি মামলাটি তদন্ত করছে।
মোবাইলে স্বজনদের বিভ্রান্ত করে অপরাধীরা
আনোয়ারুল আজীম আনার নিখোঁজ হওয়ার পর স্বজন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিভ্রান্ত করতে ভিন্ন ভিন্ন বার্তা দেওয়া হয়। যেসব তারিখে এসব বার্তা পাঠানো হয়েছে তখন বেঁচে নেই আজীম। দুর্বৃত্তরা তার মোবাইল নিজেদের হেফাজতে রেখে এসব বার্তা স্বজনদের দিতেন।
যত মামলা আজীমের বিরুদ্ধে
ঝিনাইদহ সীমান্ত দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে স্বর্ণ চোরাচালান, হুন্ডিসহ বিভিন্ন অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম। বিভিন্ন সময় তার বিরুদ্ধে ২১টি মামলা হয়েছিল। অস্ত্র, বিস্ফোরক, মাদকদ্রব্য ও স্বর্ণ চোরাচালান, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি এবং চরমপন্থিদের আশ্রয় দেওয়ার মতো অভিযোগ ছিল এসব মামলায়। এর মধ্যে ১৪টি মামলায় তিনি আদালত থেকে খালাস; আর বাকি মামলায় ‘ডিসচার্জ’ (অব্যাহতি) পান। ২০০১ সাল থেকে ২০০৭ সালের (বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে) মধ্যে আজীমের বিরুদ্ধে ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর, কালীগঞ্জ এবং চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা থানায় এসব মামলা হয়েছিল। যদিও বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এলে তিনি সবগুলো মামলা থেকে নিজেকে মুক্ত করেন।
একসময় আনোয়ারুল আজীমের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি ছিল। তাছাড়া কুষ্টিয়া অঞ্চলের চরমপন্থি নেতা মুকুলের সঙ্গেও তার বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল। আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার সংক্রান্ত অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০০৬ সালে ইন্টারপোলের তালিকায় আজীমের নাম ওঠে। ২০০৯ সালে ইন্টারপোলের ওয়ান্টেড তালিকা থেকে নাম প্রত্যাহার হওয়ার পর এলাকায় ফিরে আগের মতোই কর্মকাণ্ড শুরু করেন তিনি।
আজীমের পৈতৃক বাড়ি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের মধুগঞ্জ বাজার এলাকায়। তিনি কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে টানা তিনবার আওয়ামী লীগ থেকে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বিএনপির আমলে যৌথবাহিনীর অভিযানের সময় তিনি পার্শ্ববর্তী দেশে পলাতক ছিলেন।
তথ্যসূত্র- ঢাকাটাইমস
Leave a Reply