বিশেষ সংবাদ:
পুলিশের আরেক ‘ধনকুবের’ কর্মকর্তার সম্পদের অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই কর্মকর্তার একার ‘কামাইয়ে’ পুরো পরিবার বিত্তশালী হওয়ার ঘটনায় বিস্ময়ে হতবাক অনুসন্ধানকারীরা। তাদের কাছে তথ্য আছে-ওই পুলিশ কর্মকর্তা গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে তৈরি করেছেন নজরকাড়া বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স। বাড়ির সামনে বিশাল সরকারি পুকুর দখলে নিয়ে করেছেন ভরাট। একই এলাকায় ভাইদের নামে গড়ে তুলেছেন ‘কানাডা সুপার মার্কেট’। ঢাকার ফার্মগেট এলাকার ইন্দিরা রোডে আছে বহুতল বাড়ি আর গুলশানে ১৫ কোটি টাকার ৬ হাজার স্কয়ার ফুটের ফ্লোর। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় নামে-বেনামে এমন কয়েক শ কোটি টাকার সম্পদের পাহাড় গড়ার অভিযোগ যার বিরুদ্ধে, তিনি ঢাকার সিটি এসবিতে (নগর স্পেশাল ব্রাঞ্চ) কর্মরত অ্যাডিশনাল ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলাম শিমুল। তার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের এন্তার অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদকের তিন সদস্যের একটি টিম। এই টিমের নেতৃত্বে আছেন সংস্থার উপপরিচালক মো. নূরুল হুদা। প্রাথমিক অনুসন্ধানে অভিযোগের বেশকিছু সত্যতা পাওয়ায় তার সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত চেয়ে মহাপুলিশ পরিদর্শককে চিঠি দিয়েছে দুদক। চিঠিপ্রাপ্তির ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
দুদক সূত্রে জানা যায়, ১৩ মে শিমুলের সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত চেয়ে মহাপুলিশ পরিদর্শককে চিঠি পাঠিয়েছেন অনুসন্ধান দলের প্রধান মো. নূরুল হুদা। চিঠিতে তার চাকরিতে যোগদানের তারিখ, পদের নাম, বিপি নম্বরসহ চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর অদ্যাবধি অর্থবছরভিত্তিক প্রাপ্ত বেতনভাতার পরিমাণ এবং তৎসংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্রের সত্যায়িত কপি চাওয়া হয়েছে। তিনি পুলিশ বিভাগে কততম বিসিএস-এর মাধ্যমে যোগদান করেন এবং কোনো বিশেষ কোটায় চাকরি পেয়েছেন কি না, এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত চাওয়া হয়েছে। এছাড়া পাবলিক সার্ভিস কমিশন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, ভূমি অফিসসহ বিভিন্ন দপ্তরে নথিপত্র তলব করে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে, মৃত বাবা রাজ্জাক শেখের নামে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ তৈরি করে ২০০১ সালে ২০তম বিসিএসে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সহকারী পুলিশ সুপার পদে চাকরি নেন।
নামে-বেনামে যত সম্পদ : দুদকের কাছে তথ্য রয়েছে, রফিকুল ইসলাম শিমুল পুলিশবাহিনীতে যোগদানের আগে গোপালগঞ্জের পাইককান্দি ইউনিয়নের ২৯ পাইককান্দি মৌজায় বিআরএস ৪৭ নম্বর দাগে নির্মিত বাড়িতে তাদের একটিমাত্র টিনের ঘর ছিল। সম্পদ বলতে তেমন কিছু ছিল না। এখন ২৭ নম্বর বিজয়পাশা মৌজায় শোভাবর্ধন করে অন্তত ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত তার বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি। গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার বিজয়পাশার বিআরএস ৩২৬ নম্বর দাগে ভাই মাহফুজুর রহমানের নামে ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকায় জায়গা কিনেছেন শিমুল। ওই জায়গায় অন্তত ৫০ লাখ টাকা খরচে বহুতল ফাউন্ডেশন দিয়ে একটি মার্কেট নির্মাণ করা হয়েছে। যেটির নাম ‘কানাডা সুপার মার্কেট’। পাইককান্দি ইউনিয়নের আমুড়িয়া মৌজায় বিআরএস ৩৫৫ নম্বর দাগে স্ত্রী ফারজানা রহমানের নামে ৯৮ লাখ টাকায় ৪৯ শতাংশ জমি কিনেছেন তিনি। ২০২৩ সালে বিজয়পাশা মৌজায় বিআরএস ৫৩৯ ও ৫৪১ নম্বর দাগে ২০ কাঠা জমি কেনেন ভাই মাহফুজুর রহমানের নামে। এই জমির দাম ২৫ লাখ টাকা। শুকতাইল ইউনিয়নের শুকতাইল গ্রামে ১৬ কোটি টাকায় একই ভাইয়ের নামে কেনা ৪০ বিঘা জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে মাছের খামার।
ঢাকায়ও শিমুলের বিপুল সম্পদের খোঁজ পেয়েছে দুদক। এর মধ্যে মিরপুর চিড়িয়াখানার পাশে ১২ কোটি ১৯ লাখ টাকায় প্রায় ২ বিঘা জমি আছে। সেখানে টিনশেড ভবনে ৬৩টি রুম বানিয়ে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। ফার্মগেট এলাকায় ৮২/২, ইন্দিরা রোডে বহুতল বাড়ি কিনেছেন স্ত্রীর এক আত্মীয়র নামে। বাড়িটির দাম প্রায় ৫০ কোটি টাকা। ২০২২ সালে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালের পাশে ৬ হাজার স্কয়ার ফুটের একটি ফ্লোর কিনেছেন শিমুল। যার দাম ১৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এর আগে ২০১৯ সালে রাজউক ঝিলমিল প্রকল্পে স্ত্রী ফারজানা রহমানের নামে ১০ কোটি টাকায় দুটি প্লট কেনেন তিনি। এছাড়াও পূর্বাচল ঢাকা প্রকল্পে পাঁচ ভাই-এসএম নূরুল ইসলাম, এসএম দিদারুল ইসলাম, এসএম আমিনুল ইসলাম, এসএম মনিরুল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমানের নামে পাঁচটি প্লট বুকিং দিয়ে কিস্তি দিচ্ছেন। প্রতিটি প্লটের কিস্তি ৩৩ লাখ টাকা হিসাবে ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হবে। চলমান কিস্তির টাকা পরিশোধ করেন শিমুল। বোন ফেরদৌসী আরার নামে ১০ কোটি টাকার এফডিআর করার অভিযোগও আছে। ভাই আমিনুল ইসলামের নামে ১০৯, কাকরাইল কর্ণফুলী গার্ডেন সিটির ১৮ডি নম্বর ফ্ল্যাট ১ কোটি ১০ লাখ টাকায় কিনেছেন। আরেক ভাই দিদারুল ইসলাম ও তার স্ত্রী সাঈদা আমেলি জামানের নামে কাদেরাবাদ হাউজিংয়ে ৭/এ নম্বর রোডের ৩ নম্বর বাসায় ৮০ লাখ টাকায় একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। এছাড়াও বড় ভাই নূরুল ইসলাম, মেজো বোনের স্বামী সাখায়েত হোসেন মোল্লাসহ অন্য আত্মীয়স্বজনের নামে বিভিন্ন জায়গায় বিপুল সম্পদ গড়েছেন। শিমুলের সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগের অভিযোগ রয়েছে শ্যালক মামুনের শিপিং ব্যবসায়। এসব সম্পদের তথ্য যাচাই-বাছাই করতে বিভিন্ন দপ্তর থেকে প্রমাণাদি সংগ্রহ করছে দুদক।
জবরদখল : দুদক সূত্র আরও জানায়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারি সম্পত্তি দখলের অভিযোগও আছে শিমুলের বিরুদ্ধে। তার গ্রামের নজরকাড়া ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে ১ দশমিক ৭ একর সরকারি পুকুর ভরাট করে বাড়ির জায়গার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেন। এছাড়াও প্রতিবেশী আসমা বেগমের ৩ কাঠা এবং শাহ আলম শেখের আরও কিছু জায়গা দখল করে তার সীমানাভুক্ত করেন। পাবনার এসপি থাকাকালে শিমুলের বিরুদ্ধে এক মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি জবরদখল করে দেওয়ার ঘটনা নিয়ে যুগান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদন আলোচিত হয়েছিল।
বক্তব্য : দুদকের অনুসন্ধান ও সপরিবারে বিপুল বিত্তশালী হওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে অ্যাডিশনাল ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলাম শিমুলের মোবাইল ফোনে তিনদিনে (বৃহস্পতিবার, শনিবার ও রোববার) একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। একই নম্বরে বক্তব্য চেয়ে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি জবাব দেননি। রোববার বেলা সাড়ে ১১টায় কর্মস্থল বেইলি রোডের সিটি এসবি কার্যালয়ে গিয়েও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। এরপর ইন্দিরা রোডের বাসায় গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে তার স্ত্রী ফারজানা রহমান উল্লিখিত অভিযোগ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, ‘পারিবারিক দ্বন্দ্বের জেরে এই নোংরামি চলছে। এ নিয়ে আমরা চরম বিব্রতকর অবস্থায় আছি। নিশ্চয়ই একসময় এর অবসান হবে। আমাদের এত সম্পদ নেই। বানিয়ে বানিয়ে দুদকে অনেক ভিত্তিহীন অভিযোগ করা হয়েছে। আমাদের যতটুকু সম্পদ, তা আয়কর ফাইলে উল্লেখ আছে। অবৈধ কোনো সম্পদ আমাদের নেই। দুদক আমাদের কাছে যেসব তথ্য-উপাত্ত চেয়েছে, আমরা সেগুলো জমা দিয়েছি।’ আপনি গৃহিণী, আপনার এত সম্পদ হলো কীভাবে-এ প্রশ্নের জবাব তিনি কৌশলে এড়িয়ে যান। পরিবারের সবার নামে সম্পদ কেনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ধরেন আপনি সলভেন্ট। আপনি চোখের সামনে যদি দেখেন আপনার বড় ভাইয়ের কোনোরকমে সংসার চলছে, তাহলে আপনি কি তাকে হেল্প করবেন না? আপনার ভাগনি যদি আজ বিপদে পড়ে, তাকে সহযোগিতা করবেন না। এগুলো কি দোষের? আজ শিমুল এ পর্যায়ে আসার পেছনে তার বড় ভাইদের অনেক অবদান আছে। আমার বড় ভাসুর নিজে টিউশন করিয়ে আমার হাজবেন্ডকে পড়িয়েছেন। আজ সে বড় অফিসার হয়েছে বলে কি ভাইদের ভুলে যাবে?’
তথ্যসূত্র-যুগান্তর
Leave a Reply