বিশেষ সংবাদ:
মালয়েশিয়া যেতে ব্যর্থ হাজারো ক্ষুব্ধ শ্রমিক জবাব চান । সিন্ডিকেটভুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে মালয়েশিয়ায় যেতে ব্যর্থ হয়ে হাজারো অভিবাসন প্রত্যাশী এখন এজেন্সি আর দালালদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।
সময়ের মধ্যে রিক্রুটিং এজেন্সির কাছ থেকে টিকিট না পেয়ে ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মালয়েশিয়াগামী শত শত কর্মী এভাবেই অপেক্ষা করছিলেন। ফাইল ছবি: টিবিএস
সিরাজগঞ্জের কাপড়ের দোকানে কাজ করতেন আবদুল মোমিন। দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে ভালোই চলছিল চারজনের সংসার। তবে আরও কিছুটা ভালো থাকার আশায় মালয়েশিয়া যেতে একই এলাকার ফজলুল হক নামে এক দালালের মাধ্যমে আল হেরা ওভারসিজ রিক্রুটিং এজেন্সির হাতে তুলে দেন প্রায় ৬ লাখ টাকা।
এরপর থেকে প্রায় দেড় বছর ধরে দালালের পিছনে ঘোরা শুরু হয় এই মালোয়েশিয়া অভিবাসন প্রত্যাশীর।
শেষ পর্যন্ত, শুক্রবার (৩১ মে) নির্ধারিত সময়সীমার শেষদিনেও টিকিট না পাওয়ায় মালয়েশিয়া যাওয়ার স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি মোমিনের।
“এনজিও থেকে উচ্চ সুদে ৬ লাখ টাকা ঋণ নেই। মালয়েশিয়া যাওয়ার ব্যবস্থা হলো না; এখন আমি কোন মুখে বাড়ি ফিরে যাব? স্ত্রী ফোন দিয়ে জানালো, আমার বিদেশ যাওয়া হয়নি জেনে বাড়িতে এসে মানুষ ভীড় করছে,” কান্নাজড়িত কণ্ঠে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে কথাগুলো বলছিলেন মোমিন।
সিন্ডিকেটভুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে মালয়েশিয়ায় যেতে ব্যর্থ হয়ে শত শত অভিবাসন প্রত্যাশী এখন এজেন্সি আর দালালের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।
তাদের একটাই জিজ্ঞাসা— ‘আমরা কি আর মালয়েশিয়া যেতে পারবো? যদি না পারি, তাহলে আমাদের ধার-দেনা করে জমা দেওয়া টাকাগুলো কবে ফেরত পাব?’
মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুক এমন শত শত লোককে শুক্রবার ঢাকা বিমানবন্দরে জড়ো হতে দেখা যায়। এদিন ছিল মালয়েশিয়া সরকারের বেধে দেওয়া সময়সীমার শেষদিন। এই শেষদিনেও রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুদের টিকিট সরবরাহ করতে না পারায় বিমানবন্দরে জড়ো হয়েছিলেন তারা।
যদিও মালয়েশিয়া সরকার নতুন করে সময়সীমা বাড়ানোর কোনো ঘোষণা এখন পর্যন্ত দেয়নি, তবুও বিভিন্ন এজেন্সি বিদেশগমনেচ্ছু কর্মীদের আশ্বাস দিচ্ছে, এক সপ্তাহের মধ্যে তাদের যাওয়ার কোনো একটা ব্যবস্থা হবেই।
আর যদি তা একেবারেই সম্ভব নাই হয়, তাহলে কর্মীদের টাকা ফেরত দেওয়ার আশ্বাসও দিচ্ছেন তারা।
এদিকে আলহেরা ওভারসিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহাদাত হোসেন জানান, “আমাদের এজেন্সি থেকে মোট ২৫ জন মালয়েশিয়াগামী কর্মী যেতে পারেনি। মালয়েশিয়ার যে প্রতিষ্ঠানে তাদের যাওয়ার কথা ছিল, সে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা জানিয়েছে, যেতে না পারা কর্মীদের মধ্যে যাদের ই-ভিসা আছে, তাদের বিষয়ে মালয়েশিয়া সরকার ব্যবস্থা নিতে পারে।”
তারপরেও কোনো কর্মী যেতে না পারলে তাদের টাকা সংশ্লিষ্ট দালালের মাধ্যমে ফিরিয়ে দেওয়া হবে বলে জানান শাহাদাত হোসেন।
সরকার নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয় ৭৯ হাজার টাকা হলেও এসব কর্মীদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে।
বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পরেও মালয়েশিয়া সরকারের বেধে দেওয়া ৩১ মে সময়সীমার মধ্যে বিমানের টিকিট জোগাড় করে এসব কর্মীদের পাঠাতে ব্যর্থ হয়েছে এজেন্সিগুলো।
এদিকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী শনিবার (১ জুন) একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে সাক্ষাৎকারের সময় বলেন, “যেসব এজেন্সি মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের দুর্দশার জন্য দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
“আমরা এজেন্সিগুলোকে ১৫ এপ্রিলের মধ্যে যারা মালয়েশিয়া যাচ্ছে তাদের তালিকা দিতে বলেছিলাম, কিন্তু তারা কোনো তালিকা দিতে পারেনি,” বলেন তিনি।
আবদুল মোমিনের মতোই আরেকজন হলেন শেরপুরের শাহীন হোসেন। মালয়েশিয়া যেতে তিনি সাড়ে ৫ লাখ টাকা তুলে দিয়েছিলেন শাহজালাল এয়ার ইন্টারন্যাশনালের কাছে।
শাহীন পেশায় ছিলেন একজন মুদি ব্যবসায়ী। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে ব্যবসায় পুষিয়ে উঠতে না পেরে দোকান বিক্রি করে মালয়েশিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
শাহীন জানান, “দোকান বিক্রি করে বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজন ও এনজিও থেকে লোন নিয়ে দালালের হাতে টাকা তুলে দেই। এখন আমি নিঃস্ব হয়ে দালাল ও এজেন্সির দ্বারে দ্বারে ঘুরছি।”
“এখন আমার না বাড়ি ফিরে যাওয়ার কোনো উপায় আছে, না আছে ঢাকায় থাকার। মরা ছাড়া সামনে আর কোনো পথ দেখছি না,” আক্ষেপ করে বললেন শাহীন।
শাহজালাল এয়ার ইন্টারন্যাশনালের মালিক শাহজালাল হোসেন সাজ্জাদ জানান, “আমার মোট ৬০-১০০ জন কর্মী যেতে পারেনি। এদের যেতে না পারার মূল কারণ দালালের কাছে কর্মীরা সব টাকা বুঝিয়ে দিলেও তারা আমার কাছে যথা সময়ে টিকিট ও অন্যান্য খরচ বুঝিয়ে দেননি।”
তিনি বলেন, “ফলে অনেকের ই-ভিসা হয়ে থাকলেও আগেই তাদের টিকেট করতে পারিনি। এ কারণে শেষ সময়ে এসে টিকিট করার চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি।”
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিস (বায়রা)- এর মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, “যেসব শ্রমিকরা যেতে পারেনি, তাদের বিষয়ে বায়রা এবং মন্ত্রণালয় যৌথভাবে কাজ করছে। তাছাড়া, যদি কোনো এজেন্সির অবহেলার কারণে কোনো কর্মী যেতে ব্যর্থ হয়ে থাকেন, তবে বায়রা সেই এজেন্সির বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।”
বর্তমানে ১০০টি রিক্রুটিং এজেন্সির একটি সিন্ডিকেট মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাচ্ছে বলে জানা গেছে।
এদিকে, এজেন্সিগুলোর সিন্ডিকেট এবং প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় মালয়েশিয়াগামী কর্মীদেরকে সময়মতো টিকিট সরবরাহ করতে না পারার জন্য একে অপরকে দোষারোপ করলেও, ঠিক কত সংখ্যক কর্মী যেতে ব্যর্থ হয়েছেন, সে ব্যাপারে কেউই গণমাধ্যমকে কোনো তথ্য দেয়নি।
বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী গতকাল বলেন, “আজ অফিস বন্ধ থাকায় আমরা এখনো চূড়ান্ত সংখ্যা পাইনি। এই তথ্য আমরা আগামীকাল দিতে পারব।”
তিনি বলেন, “সংখ্যাটি প্রায় ৩ থেকে ৪ হাজারের মতো হতে পারে।”
তবে খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, মালয়েশিয়া কর্তৃক নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে যেতে না পারা কর্মীদের এই সংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি হতে পারে।
সিন্ডিকেট সদস্যদের একজন এবং বায়রার সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমানের মতে, গত ৩০ মে পর্যন্ত অন্তত ১০ থেকে ১৫ হাজার কর্মী যেতে ব্যর্থ হয়েছেন।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ১৫ বছরে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার তিনবার বন্ধ হয়েছে। এর প্রতিবারই কর্মী পাঠানোর সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেটের অন্তর্ভুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষের অভিযোগ উঠলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২২ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ বাংলাদেশি কর্মী মালয়েশিয়ায় গিয়েছেন।
চার বছরের স্থগিতাদেশের পর ২০২২ সালে আবারও বাংলাদেশিদের জন্য শ্রমবাজার খুলে দেয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশ।
তবে সিন্ডিকেটের অনিয়মের জেরে শুক্রবার থেকে আবারও বন্ধ হয়ে গেছে এই শ্রমবাজার।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক অভিবাসী শ্রমিক ও মানবাধিকার বিষয়ক ইস্যুতে ধারাবাহিকভাবে মালয়েশিয়া সফর করবেন বলে জানা গেছে।
কুয়ালালামপুর সূত্র দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছে, এসময় বাংলাদেশসহ মালয়েশিয়ার মোট ১৪টি উৎস দেশ (প্রবাসী কর্মীদের) থেকে আগত অভিবাসী কর্মীদের দুর্বল শ্রম অধিকার পরিস্থিতির সমাধান হতে পারে।
সূত্র জানায়, মালয়েশিয়ায় অভিবাসী শ্রমিকদের সাম্প্রতিক বেকারত্ব নিয়ে মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইতোমধ্যেই তাদেরকে ব্রিফ করেছে।
এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় যাওয়া সাড়ে চার লাখ কর্মীর মধ্যে কয়েক হাজার কর্মী কাজ না পাওয়ায় বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘসহ শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো।
Leave a Reply