বিশেষ সংবাদ :
শুক্রবার (৩০ আগস্ট) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সকাল সাড়ে ১০টায় আন্তর্জাতিক গুম দিবস উপলক্ষে ‘মায়ের ডাক’-এর ব্যানারে আয়োজিত মানববন্ধনে উপস্থিত হয়ে গুমের শিকার কাউসার হোসেনের মেয়ে লামিয়া কেঁদে কেঁদে এভাবে কথাগুলো বলেছে এবং তার বাবাকে ফেরত চেয়েছে।
শুধু লামিয়া নয়, গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের অন্য সদস্যরাও স্বজন হারানোর শোকে আর্তনাদ করেন এবং তাদের স্বজনকে ফেরত চান। এ সময় সবার হাতে ছিল বিভিন্ন ব্যানার-পোস্টার ও প্ল্যাকার্ড।
গুম থেকে ফিরে আসা মাইকেল চামকা বলেন, ‘২০১৯ সালের ৮ এপ্রিল ঢাকার কল্যাণপুর থেকে আমাকে সাদা পোশাকধারী সাত জন আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। শেখ হাসিনার পতনের পর আমাকে আমার এলাকার একটি জায়গায় ছেড়ে দিয়ে আসে। সেখান থেকে আমি বহু কষ্টে বাড়ি পৌঁছি। শেখ হাসিনা এই গুমের মাধ্যমে আমাদের এই ভয় দেখিয়েছিলেন। সরকার ইচ্ছা করলে মাসের পর মাস গুম করে রাখতে পারে। আমরা সব গুম-খুনের ন্যায়বিচার চাই। এখানে যারা কান্না করছে, তাদের কষ্ট আমি বুঝি। দেশে আয়নাঘর নামে যেসব বন্দিশালা আছে, এগুলো বন্ধ করতে হবে। লেখক-কবি-শিল্পীরাসহ সবাই এসবের বিরুদ্ধে না দাঁড়ালে তা বন্ধ হবে না।’
গুম হওয়া ইসমাইল হোসেনের মেয়ে আনিকা ইসলাম ইশা বলেন, ‘আমার বাবাকে আমার কাছ থেকে দূরে রাখা হয়েছে। আমার ছোট ভাই প্রতিদিন আশায় থাকে বাবা ফিরবে বলে। মাঝে মধ্যে সে প্রশ্ন করে, বাবা কেন আসে না? আমরা বাবাকে হারিয়ে অসহায়, আমার বাবাকে ফেরত চাই, আমার ভাইয়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই। আমার বাবার কী হয়েছে জানতে চাই।’
ক্লোজআপ ওয়ানের তারকা শিল্পী এইচ এম রানা বলেন, ‘আমাকে ডিবি অফিস থেকে ফোন দিয়ে বলে আপনি আসুন, চা খেয়ে চলে যাবেন। তারপর আমি গেলে আমাকে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় একটি বাড়িতে আটক রাখা হয়। আমার পরিবারকে মানসিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আমার পরিবারের কাছ থেকে তিন লাখ টাকা আদায় করা হয়। আমি মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করেছিলাম বলে আমাকে জামায়াত-শিবির ট্যাগ দিয়ে আটক রাখা হয়। আমি কাজ হারিয়ে এখন মানবেতর জীবনযাপন করছি।’
অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ও মানবাধিকারকর্মী সাইয়েদ আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের অনেক মানবাধিকার সংগঠন পার্টি স্টেট। কিন্তু এগুলো শুধু লিখিত ও নামসর্বস্ব। আজ এখানে এসে যেসব বাচ্চা কান্না করলো, তাদের হাসি ফিরিয়ে দিতে না পারলে আমাদের এগুলো ব্যর্থ।’
গুমের শিকার সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান বলেন, ‘২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর আমাকে বন্দুক তাক করে গুম করা হয়েছিল। পরে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সঙ্গে আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে মিটিং করেছি, কীভাবে তাদের সহায়তা করা যায়। আমরা চাই এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে কমিশন করেছে, তাদের মাধ্যমে সব গুমের দ্রুত বিচার করতে হবে। পুরো স্টেট মেশিনারিকে আইডেন্টিফাই করতে হবে।’
বিভিন্ন সময়ে বিরোধী মতের ব্যক্তিদের গুম করা হয়েছে বলে অভিযোগ করে আসছেন এসব ভুক্তভোগী পরিবার। নিখোঁজ অনেকেই ফিরে এসে ‘আয়নাঘর’ নামক গোপন কারাগারে বন্দি ছিলেন বলে দাবি করেছেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়ে এখনও চুপ আছে। তাই গুমের বিষয়ে দ্রুত সুস্পষ্ট ঘোষণাসহ শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি জানিয়ে আসছেন বিশিষ্ট নাগরিকরা।
এ বিষয়ে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা সাইফুল হক বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা আন্তর্জাতিক গুমবিরোধী সনদে সই করেছেন, এ জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই। এই কমিটি একটি তদন্ত কমিটি করতে বলেছে, কিন্তু তদন্ত কমিটিই যথেষ্ট নয়। এর সঙ্গে জড়িতদের যেন আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করা হয়। বিষয়টি তদন্ত কমিটির কার্যাবলির মধ্যে দেওয়া হোক। গুরুত্ব দিয়ে গুম হওয়া ব্যক্তিদের যেন তাদের পরিবারের কাছে ফেরত দেওয়া হয়।’
এ সময় তিনি আয়নাঘর নিয়ে সরকারের কাছে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যাসহ শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি জানান।
দ্রুত সুস্পষ্ট ঘোষণাসহ শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি জানিয়ে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আমাদের এখন অতীতকে স্মরণ করে ভবিষ্যৎ গড়তে হবে। কল্পনাও করা যাবে না, গত সরকারের অধীনে পুলিশ কতটা অমানবিক ছিল। আমি ২৩ ঘণ্টা গুম ছিলাম, দুই মাস জেলে ছিলাম। সে সময় এমন অনেক ঘটনা দেখেছি, সেগুলো লিখলে বিরাট এক বই হয়ে যাবে। গুম নিয়ে মায়ের ডাকসহ অনেকেই তালিকা তৈরি করেছে। তার ৯৫ শতাংশের মতো সঠিক। তবে শতভাগ সঠিক করতে পারবেন কিনা জানি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত জুলাইয়ে কত মানুষ মারা গেছে? হয়তো হাজারেরও বেশি। আমরা বলতে চাই, তাদের হত্যার বিচার করতে হবে। যারা গুম-খুনের শিকার হয়েছেন, তাদের কাছে আমাদের যেতে হবে, সরকারকে যেতে হবে। আমরা যে মানবিক বাংলাদেশ গড়তে চাচ্ছি, সেই বাংলাদেশে সব মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’
তথ্যসূত্র – বাংলা ট্রিবিউন
Leave a Reply