বিশেষ প্রতিবেদন :
মস্কোর হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও চলতি সপ্তাহে রাশিয়ার গভীরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটিশদের দেওয়া ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে ইউক্রেন। কিয়েভের এই হামলা ৩৩ মাস ধরে চলা যুদ্ধে দ্রুত উত্তেজনা বৃদ্ধির সর্বশেষ গুরুতর পদক্ষেপ ছিল।
কিয়েভের এমন দুঃসাহস দেখানোর প্রেক্ষাপটে ইউক্রেনে হামলায় প্রথমবারের মতো আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম) ছুড়েছে রাশিয়া। স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার ইউক্রেনে হামলার সময় এই ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করে মস্কো। আইসিবিএমটি হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে পারমাণবিক হামলা চালানোর জন্য ডিজাইন করা।
এ অবস্থায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, যেসব দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য ইউক্রেনকে অস্ত্র দিচ্ছে, তিনি সেসব দেশের বিরুদ্ধেও আঘাত হানতে বাধ্য হবেন।
স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) রাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে তিনি এই হুশিয়ারি দেন। পুতিন বলেন, কুরস্ক ও ব্রায়ানস্কের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে রুশ সামরিক স্থাপনায় মার্কিন ও ব্রিটিশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার আগে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো মিত্ররা দূরপাল্লার গাইডেট অস্ত্র ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছিল। তার মতে, পশ্চিমাদের উস্কানিমূলক নীতি আরও বাড়লে বড় পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
‘যে কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত’
হায়ার স্কুল অব ইকোনমিকসের সেন্টার ফর কম্প্রিহেনসিভ ইউরোপিয়ান অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ডেপুটি ডিরেক্টর দিমিত্রি সাসলভ যুক্তি দেখিয়েছেন, পুতিনের বক্তব্য দেখিয়ে দিয়েছে, রাশিয়া নড়বড়ে হওয়ার পশ্চিমা আশা কতটা নিরর্থক করে দিয়েছে। দেশটি যে কোনো কিছুর জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
ভালদাই ডিসকাশন ক্লাবের বিশেষজ্ঞ প্যানেলে থাকা সুসলভ বলেন, পুতিনের ভাষণের গুরুত্বপূর্ণ বার্তাটি হলো, রাশিয়া বিশ্বাস করে যে পশ্চিমারা প্রক্সি-যুদ্ধ থেকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঝুঁকেছে।
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় দুমা (পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ) প্রতিরক্ষা বিষয়ক কমিটির প্রধান আন্দ্রে কার্তাপোলভ বলেছেন, রাশিয়ার সর্বশেষ আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার নিয়ে পুতিনের বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে সম্মিলিত পশ্চিমাদের মধ্যে ‘ভয় ও ভূমিকম্প’ দেখা দিয়েছে।
পশ্চিমাদের প্রতি বার্তা
ব্রাজিলিয়ান ম্যাগাজিন ফোরাম জানিয়েছে, বিশেষ সামরিক অভিযানের সময় আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার উত্তর আটলান্টিক জোটের (ন্যাটো) দেশগুলোকে একটি স্পষ্ট সংকেত পাঠিয়েছে যে, রাশিয়ান সামরিক বাহিনী যে কোনো দূরত্বে ন্যাটোর যে কোনো সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।
তারা পরামর্শ দিয়েছেন, এই পদক্ষেপটি পোল্যান্ডের মনকেও শান্ত করবে। কারণ দেশটিতেও রাশিয়ান ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানতে সক্ষম।
বুলগেরিয়ান বিশেষজ্ঞ বোয়ান চুকভ বলেন, যারা সংঘাত বাড়াতে চায় তাদের পুতিন ‘লাল কার্ড’ দেখিয়েছেন।
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কূটনৈতিক একাডেমির বৈজ্ঞানিক কাজের ভাইস-রেক্টর ওলেগ কারপোভিচ বলেছেন, পুতিন পশ্চিমা দেশগুলোকে স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, তাদের কর্মকাণ্ড বিশ্বকে পারমাণবিক সংঘাতের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
তুরস্কের প্যাট্রিয়টিক পার্টির (ভাতান পার্টিসি) ডেপুটি চেয়ারম্যান হাকান তোপকুরুল ইউক্রেনের বিরুদ্ধে অ-পারমাণবিক হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে পুতিনের বক্তব্যকে পশ্চিমা ন্যাটো জোটের জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশল বিশেষজ্ঞ অবসরপ্রাপ্ত সুইস লেফটেন্যান্ট কর্নেল রালফ বসহার্ড বলেছেন, যেসব দেশ কিয়েভকে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে তাদের আরও ভেবে দেখা উচিত যে, মাঝারি পাল্লার আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়াও রাশিয়ার অনেক কার্যকর অস্ত্র রয়েছে, যা পশ্চিমে এখনো দেখা যায়নি।
অস্ট্রিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেট ইউনিভার্সিটির গোর্কি সেন্টারের প্রধান কারিন নাইসল বলেছেন, পুতিন ন্যাটোর অসংখ্য উস্কানির জবাব দিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমারা কেউ রাশিয়ার হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র আটকাতে পারবে না।
২০০৯-২০১৩ সালে মস্কোয় ফরাসি রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা জিন ডি গ্লিনিয়াস্টি লে জার্নাল দ্যু দিমাঞ্চকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বর্তমানে ইউক্রেন সংঘাত পারমাণবিক যুদ্ধে রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়া ইতিমধ্যে আধিপত্য বিস্তার করে আছে।
ব্রিটিশ ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্ট লিখেছে, আন্তমনাদেশীয় যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার পশ্চিমা দেশগুলোকে ইউক্রেনে নিজেদের জড়িত হওয়া থেকে বিরত করার বৃহত্তর রাশিয়ান প্রচেষ্টার অংশ।
এদিকে, রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেছেন, পোল্যান্ডে নতুন করে স্থাপন করা যুক্তরাষ্ট্রের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ঘাঁটি ‘পারমাণবিক সংঘাতের ঝুঁকি বাড়ানোর’ কারণ হতে পারে। তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন, এই ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি এখন রাশিয়ার সম্ভাব্য হামলার লক্ষ্যবস্তুতেও পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ রাশিয়া প্রয়োজন মনে করলে যে কোনো সময় এই ঘাঁটিতে হামলা চালাতে পারে।
Leave a Reply