বিশেষ প্রতিবেদন :
রাশিয়া সিরিয়ান আরব আর্মিকে (এসএএ) পেশাদার যুদ্ধ চালনায় সক্ষম বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। বাহিনীর কমান্ড কাঠামো আধুনিকীকরণ এবং উন্নত রুশ অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে এই প্রচেষ্টা চালানো হয়।
ইসলামপন্থি গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম-এর নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা তিনদিনের আক্রমণে সিরিয়ার আলেপ্পো শহরের দখল নিয়েছে। এর মাধ্যমে সিরিয়ার ওপর রাশিয়ার কর্তৃত্ব কমে আসার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
২০১৬ সালে সিরীয় সরকার যখন আলেপ্পো পুনরুদ্ধার করেছিল, তখন রাশিয়ার সামরিক শক্তি স্পষ্ট হয়েছিল। তবে বর্তমানে ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ ব্যস্ত থাকার মাঝেই সিরীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে শহরটির নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়েছে বিদ্রোহীরা।
তবে সিরিয়ার প্রতি রাশিয়ার মনোভাবের কোনো পরিবর্তন এখনও ঘটেনি। রাশিয়ার মনোযোগের দুর্বলতা নয়, বরং বাশার আল-আসাদের শাসনামলকে সমর্থনকারী বহুজাতিক বাহিনীর শক্তির অবনতির ফলে বিদ্রোহীরা আলেপ্পো শহরের দখল নেয়।
রাশিয়া এখন সিরিয়া থেকে বের হওয়ার কথা ভাবছে না। বরং সেখানে আরও বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রয়োজনে ইরান-সমর্থিত বাহিনী এবং আঞ্চলিক শক্তির সহযোগিতার ওপর নির্ভর করতে পারে মস্কো।
সিরিয়া মস্কোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ কারণ ২০১৫ সালে সেখানে হস্তক্ষেপ করার মাধ্যমে পুতিন রাশিয়ার সংকটময় অবস্থা বদলে দিতে সক্ষম হন, যা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে চলে আসছিল।
রাশিয়া আর সেই “অবনতির দিকে চলে যাওয়া আঞ্চলিক শক্তি” নয়, যেভাবে তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মন্তব্য করেছিলেন। বরং, রাশিয়া আসাদ সরকারের একটি শক্তিশালী সহায়ক শক্তি হয়ে উঠেছে এবং এর মাধ্যমে তারা মধ্যপ্রাচ্যে বাইরের হস্তক্ষেপের কৌশল নতুনভাবে নির্ধারণ করতে চেয়েছে।
মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী ইরাক আক্রমণ এবং লিবিয়ায় ন্যাটোর অভিযান চালিয়ে দেশগুলোকে ধ্বংস ও অস্থিরতা সৃষ্টি করেছিল। রাশিয়া তার বিপরীত কাজ করে সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে চেয়েছিল।
সিরিয়ায় সামরিক অবস্থান রাশিয়ার বোঝার জন্য কয়েকটি ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে যখন মস্কো প্রথম সেখানে হস্তক্ষেপ করেছিল, তখন তাদের অপ্রত্যাশিতভাবে সামান্য উপস্থিতি ছিল। পাশাপাশি সিরিয়ার সামরিক বাহিনীকে আধুনিকীকরণ ও শক্তিশালী করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেছিল দেশটি।
মস্কো সে সময় শুধু ২,৫০০ থেকে ৪,৫০০ সৈন্য পাঠিয়েছিল, যা মূলত বিমান শক্তি, বিমান প্রতিরক্ষা, এবং বিশেষ বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল ছিল। আর পদাতিক বাহিনী সরবরাহের জন্য তারা ইরান এবং তার সহায়কদের ওপর নির্ভর করেছিল।
খমেইমিম বিমান ঘাঁটি থেকে রাশিয়ার ট্যাকটিক্যাল বিমান বাহিনী গ্রাউন্ড (স্থল) অপারেশনগুলিকে পরিচালনা করত। রাশিয়ার দীর্ঘ পাল্লার বোম্বার বিমান এবং ভূমধ্যসাগরে রুশ যুদ্ধজাহাজের ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র সিরিয়ার গভীরে অবস্থিত লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ চালায়।
এছাড়া মস্কো উন্নত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যেমন এস-৪০০, এস-৩০০ এবং প্যান্টস্যার এর সঙ্গে সিরিয়াকে ইলেকট্রনিক যুদ্ধ সক্ষমতা সম্পন্ন সরঞ্জামও সরবরাহ করেছিল।
সিরিয়ায় রাশিয়ার কৌশল বাস্তবায়নে বিশেষ অভিযান ইউনিট, সামরিক পুলিশ, উপদেষ্টা এবং পদাতিক দল পাঠানো হয়েছিল। তবে তারা মূলত বিদ্রোহীদের কাছ থেকে সিরিয়ার বিভিন্ন এলাকা পুনরুদ্ধার করতে ইরান-সমর্থিত বাহিনী [যেমন হিজবুল্লাহ এবং আইআরজিসি] ওপর নির্ভর করেছিল।
রাশিয়া সিরিয়ান আরব আর্মিকে (এসএএ) পেশাদার যুদ্ধ চালনায় সক্ষম বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। বাহিনীর কমান্ড কাঠামো আধুনিকীকরণ এবং উন্নত রুশ অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে এই প্রচেষ্টা চালানো হয়।
২০২২ সালে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার আক্রমণ শুরুর পরেও রাশিয়া সিরিয়ায় তার সামরিক উপস্থিতি সমন্বয় করেছিল। তবে খমেইমিম বিমানঘাঁটি কার্যকর রাখা হয়েছিল এবং ভূমিতে নিজেদের সরাসরি উপস্থিতি কমিয়ে ইরান-সমর্থিত বাহিনীর ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে ওঠে রাশিয়া। এসময় সিরিয়া থেকে কিছু কমান্ড পোস্ট স্থানান্তর করে রাশিয়া।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ মধ্যপ্রাচ্যে মস্কোর অবস্থান পরিবর্তন করেছে। সিরিয়ায় যুক্ত হওয়ার পর মস্কো ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রেখেছিল।
২০১৮ সালে তারা গোলান উচ্চভূমি থেকে প্রায় ৫০ মাইল দূরে ইরানি বাহিনীকে সীমাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য ইরানি ড্রোনের ওপর রাশিয়ার নির্ভরতা মস্কোকে ইরানের “প্রতিরোধ অক্ষ” এর দিকে নিয়ে যায়।
এই পরিস্থিতি তখন পর্যন্ত বড় সমস্যা মনে হয়নি, যতক্ষণ না ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে আক্রমণ করে। এরপর গাজায় যুদ্ধের বিস্তার এবং ইসরায়েলের সিরিয়ায় অস্ত্রের গুদাম লক্ষ্য করে আক্রমণ শুরু হয়, যেখানে তারা ইরানি ও হিজবুল্লাহর গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ও সদস্যদের নিশ্চিহ্ন করতে থাকে।
রাশিয়া আর ইসরায়েলি আক্রমণের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকতে পারছিল না, কারণ একই সময়ে ইরানি মদদপুষ্ট স্থলবাহিনীর ওপর তার নির্ভরতা বাড়ছিল। ইসরায়েলের লেবানন অভিযান সিরিয়ায় রাশিয়ার প্রতিষ্ঠিত পরিস্থিতি বজায় রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিজবুল্লাহকে দুর্বল করে দেওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।
মস্কোর কৌশলগত শূন্যতাগুলো এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিদ্রোহীরা আলেপ্পোতে আক্রমণ শুরু করার পর তাদের দ্রুত অগ্রগতি মস্কোকে স্থলবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করতে বা প্রয়োজনীয় আকাশ সমর্থন সংগঠিত করতে পর্যাপ্ত সময় দেয়নি।
সিরিয়ার কর্তৃপক্ষের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পতন রাশিয়ার দীর্ঘমেয়াদি কৌশলকে ব্যর্থ প্রমাণ করেছে। কুয়েরিরেস বিমানঘাঁটিতে সিরিয়ান বাহিনী প্রতিরোধ না করে আত্মসমর্পণ করেছে এবং তাদের মূল্যবান সম্পদ, হেলিকপ্টার, বিমান ও উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ত্যাগ করেছে।
তবে, এই পরিস্থিতি রাশিয়াকে সিরিয়া থেকে পিছু হটাবে না। ক্রেমলিনের অনেক কিছু রয়েছে যা রক্ষা করতে হবে। তারা সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ করে মধ্যপ্রাচ্যে নিজের প্রভাব পুনর্নির্মাণ করেছে। ইরান, তুরস্ক, উপসাগরীয় দেশগুলো, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছে। মস্কো সিরিয়ার পুনর্গঠনের জন্য লাভজনক অর্থনৈতিক চুক্তিও সুরক্ষিত করেছে।
রাশিয়া সিরিয়া থেকে সরে যাওয়ার বদলে কৌশল পরিবর্তন করতে বাধ্য হবে, কারণ দেশটির অনেক কিছু রক্ষা করতে হবে। তারা ইরানের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা শক্তিশালী করার চেষ্টা করবে, যার অংশ হিসেবে ইরাকি মিলিশিয়া এবং সৈন্যদের সিরিয়ায় নিয়োগ দেওয়া হতে পারে।
ইতোমধ্যে ইরান টেলিগ্রাম চ্যানেলের মাধ্যমে তার সিরিয়ান ব্রিগেডগুলোর পুনর্গঠন শুরু করেছে। এই বাহিনী হিজবুল্লাহর ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সাহায্য করবে। তবে ২০১৬ সালের আলেপ্পো আক্রমণের মতো কার্যকরী হবে না।
রাশিয়া তুরস্কের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে পারে, যারা কিছু বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে সমর্থন করে। গত শনিবার থেকে মস্কো তুরস্কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের কার্যকলাপ নিয়ে সমালোচনা এড়িয়ে গেছে। এটি ইঙ্গিত দেয়, রাশিয়া একটি কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে প্রস্তুত, যাতে তারা সিরিয়ার কিছু অংশে উপস্থিতি বজায় রাখতে পারে এবং তুর্কি স্বার্থের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারে।
রাশিয়া যদি এমন উদ্যোগ না নিত, তবে তাদের সামরিক দুর্বলতা প্রমাণিত হতো। ইরানি বাহিনীর শক্তি কমে গেছে, আর সিরিয়ান বিরোধী বাহিনী আরও শক্তিশালী ও সংগঠিত হয়ে উঠেছে। তারা যদি হামা থেকে হোমসের দিকে অগ্রসর হয়, তবে রাশিয়ার লাতাকিয়া এবং তাতরাসের ঘাঁটিগুলোর সঙ্গে অন্য অঞ্চলগুলোর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
যদিও ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার শক্তি ক্ষয় হয়েছে, তারা সিরিয়া থেকে সরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে না। সিরিয়া রাশিয়ার মহান শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, যেখানে তারা তার কূটনৈতিক প্রভাব প্রদর্শন করে এবং পশ্চিমা হস্তক্ষেপের বিপরীতে কৌশল অনুসরণ করে। এর ফলে, রাশিয়া সিরিয়ায় তার বিনিয়োগ অব্যাহত রাখবে, যদিও ইউক্রেন যুদ্ধ মস্কোর জন্য ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে।
Leave a Reply