বিশেষ প্রতিবেদন :
বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) খুবলে খেয়েছে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ এবং তার ঘনিষ্ঠ শক্তিশালী একটি চক্র। এ চক্রের ‘মাস্টারমাইন্ড’ এনআরবিসি ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আদনান ইমাম। বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের দ্বৈত নাগরিক এবং বিতর্কিত ব্যবসায়ী আদনানের সঙ্গে জড়িত জাভেদের ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনি, চাচাতো ভাই আলমগীর কবির অপু, এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান পারভেজ তমাল ও নাফিজ সরাফাত। জেনেক্স ইনফোসিসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আদনান ইমামের চার প্রতিষ্ঠানসহ চক্রের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ১১টি প্রতিষ্ঠানের নামে বের করে নেওয়া হয়েছে দুই হাজার কোটি টাকা।
কাগজে-কলমে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন জাভেদের স্ত্রী রুখমিলা জামান। তবে স্ত্রীর বদলে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ, ঋণ বিতরণসহ নানা অপকর্মের নাটাই ছিল জাভেদের হাতে। নিয়ম ভেঙে তিনি ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সব বৈঠকে উপস্থিত থাকতেন। প্রভাব খাটিয়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ অনুমোদন করিয়ে ঋণের অর্ধেক টাকা কমিশন হিসাবে হাতিয়ে নিতেন জাভেদ ও তার ভাই রনি। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে উল্লিখিত তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা যায়, এই ঋণ দিতে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কমিটি কোনো সুপারিশ না করলেও জাভেদের প্রভাবে তা অনুমোদন দেয় পরিচালনা পর্ষদ। এছাড়া বিধিবহির্ভূতভাবে জেনেক্স ইনফোসিসের শেয়ার কিনেও লোকসানে পড়ে ব্যাংকটি। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত ব্যাংকটিতে ভয়ংকর সব ঋণ জালিয়াতি ও অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে এসব ঋণ। ফলে ব্যাংকটির বড় অঙ্কের এই ঋণ এখন খেলাপির পথে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, এসব অনিয়ম ও ঋণ জালিয়াতির ঘটনা তুলে ধরে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) চিঠি পাঠিয়েছেন ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান শরিফ জহির। তিনি ব্যাংকের আমানতকারী ও শেয়ারধারীদের স্বার্থরক্ষায় সাইফুজ্জামান চৌধুরী, জেনেক্স ইনফোসিসের শেয়ার বিক্রেতা আমির রসুল ও জাহারা রসুল, আদনান ইমাম এবং ব্যাংকের সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমগীর কবিরের (অপু) বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। কিন্তু দুদক এ ব্যপারে এখনো কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। দুদকের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কমিশন শূন্যতার কারণে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া যায়নি। নতুন কমিশন দায়িত্ব নিয়েছেন। এখন অবশ্যই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
মোবাইল ফোনে কল করে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ইউসিবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান শরিফ জহির কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, আদনান ইমাম ও স্বার্থসংশ্লিষ্টদের মালিকানাধীন ১১ প্রতিষ্ঠানের নামে ইউসিবি ব্যাংক থেকে ১ হাজার ৯৩৭ কোটি টাকা বের করে নেওয়া হয়েছে। ঋণের এই টাকার বড় অংশই ফেরত না দিয়ে বিদেশে পাচারের অভিযোগ আছে। ফলে ইতোমধ্যে ৬০৯ কোটি টাকার বেশি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে, যা ধীরে ধীরে খেলাপি হয়ে যাবে। শুধু আবাসন খাতের দুই প্রতিষ্ঠান এডব্লিউআর ডেভেলপমেন্ট ও এডব্লিউআর রিয়েল অ্যাস্টেট লিমিটেডের নামেই ব্যাংকটি থেকে বের করা হয়েছে প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে ১২১ কোটি টাকা। এছাড়া জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেডের নামে নেওয়া ২৮৯ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ২০ কোটি এরই মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। জেনেক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের নামে নেওয়া ১৫৮ কোটির মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ১৯ লাখ টাকা। এ অ্যান্ড পি ভেঞ্চার লিমিটেডের ঋণ ৫৭ কোটি। এর মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে ৫৮ কোটি টাকা। ডায়মন্ড রিজ কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের ঋণ ২৯ কোটি। মেয়াদোত্তীর্ণ ৬ কোটি টাকা। টিএসএন ট্রেড অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের ২৫৯ কোটির মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ১৩৬ কোটি টাকা। বাংলা ইউকে অ্যাগ্রো প্রডাক্ট, ফুলপুর অ্যাগ্রো সিটি ও আরবারা অ্যাগ্রো কমপ্লেক্স লিমিটেডের ৪১৩ কোটি টাকা ঋণের অর্ধেকের বেশি (২২৩ কোটি) মেয়াদোত্তীর্ণ। ফ্রন্টায়ার টাওয়ার বাংলাদেশ লিমিটেডের ঋণ ৭৭ কোটি। মেয়াদোত্তীর্ণ ৪৫ কোটি টাকা। এসব ঋণ আর আদায় করা যাবে না বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
ইউসিবি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকে দুদকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে ব্যাংক থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণ করা হয়েছে বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেড, জেনেক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড, এ অ্যান্ড পি ভেঞ্চার লিমিটেড, এডব্লিউআর ডেভেলপমেন্ট, এডব্লিউআর রিয়েল এস্টেট লিমিটেডসহ স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করা হয়। ব্যবস্থাপনা পর্যায়ের সুপারিশ ছাড়াই এ ঋণগুলো অনুমোদিত হয় বলে নিরীক্ষায় উঠে এসেছে।
এছাড়া আনিসুজ্জামান, বশির আহমেদসহ অন্য পরিচালকদের অনুমোদনে ২০২১ সালে জেনেক্স ইনফোসিসের ৬০ লাখ ৮৩ হাজার ৬২৬টি বিক্রয় অযোগ্য (লকড-ইন) শেয়ার কেনে ইউসিবি। প্রতিটি ১৭২ টাকা ৫০ পয়সা হিসাবে মোট ১০৪ কোটি টাকার শেয়ার কেনা হয়। গত সেপ্টেম্বরে প্রতিটি শেয়ারের বাজারমূল্য কমে দাঁড়ায় ৩৮ টাকা। ফলে প্রায় ৭৮ কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ইউসিবি। এ শেয়ারের বিক্রেতা ছিলেন জাহারা রসুল, যিনি জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেডের চেয়ারম্যান আদনান ইমামের বোন এবং আমির রসুল তার বোনের জামাতা। আদনান ইমাম প্রবাসীদের উদ্যোগে গঠিত এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের উদ্যোক্তা ও এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান। এডব্লিউআর ডেভেলপমেন্ট এবং এডব্লিউআর রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান আদনান ইমামের বাবা চৌধুরী ফজলে ইমাম।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, শুধু ঋণ জালিয়াতি নয়, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর চাচাতো ভাই আলমগীর কবীর অপুকে সম্পূর্ণ ‘অযৌক্তিকভাবে’ ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ থেকে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তিনিই ব্যাংক কর্মকর্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে নিয়মবহির্ভূত ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ নিশ্চিত করেন। সরকার পতনের পরপরই তিনি বিদেশে পালিয়ে যান এবং ই-মেইলের মাধ্যমে নিজের পদত্যাগপত্র জমা দেন। বর্তমানে তিনি বরখাস্ত অবস্থায় আছেন।
জানা যায়, যুক্তরাজ্যের আবাসন খাতে মোহাম্মদ আদনান ইমামের বিপুল বিনিয়োগ আছে। তার হাত ধরেই সেখানে আবাসন খাতে বিনিয়োগ শুরু করেন জাভেদ ও তার ভাই রনি। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর শুধু যুক্তরাজ্যেই ৩৬০টি বাড়ি রয়েছে বলে বিভিন্ন অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। এসব বাড়ির বর্তমান বাজারমূল্য বাংলাদেশি টাকায় ৩ হাজার ৮২৪ কোটি টাকার বেশি। আবাসন খাতের সূত্রে আদনান ও জাভেদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠার পরই পরস্পর যোগসাজশে ব্যাংক লুটের পরিকল্পনা করে।
বক্তব্য জানতে মোহাম্মদ আদনান ইমামের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। একই মোবাইল নম্বরের হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠিয়ে সময় চাইলে তিনি সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন মেইল করতে বলেন। প্রশ্ন পাঠানোর পর জবাবে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি সাব-জুডিশিয়াল, কারণ এখানে একটি আইনি সমস্য রয়েছে। এ কারণে এসব বিষয়ে আমার মন্তব্য করা ঠিক হবে না।’
জানা যায়, ২০১৮ সালে ইউসিবি দখলে নেয় সাইফুজ্জামানের পরিবার। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ইউসিবির পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তন করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর ব্যাংকটির ঋণের অনিয়ম খতিয়ে দেখতে একাধিক নিরীক্ষা হয়। এতে ঋণ দেওয়ায় অনিয়মসংক্রান্ত এসব তথ্য উঠে এসেছে।
আরও জানা যায়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে আওয়ামী লীগের নেতা প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরীর পরিবারের হাতে ইউসিবির নিয়ন্ত্রণ ছিল। সাইফুজ্জামান চৌধুরী তার ছেলে। শুরু থেকে ব্যাংকটির সঙ্গে যুক্ত ছিল ব্যবসায়ী গোষ্ঠী পারটেক্স গ্রুপ ও অনন্ত গ্রুপ। কিন্তু ২০১৭ সালে পারটেক্স গ্রুপের প্রতিনিধিদের ইউসিবি ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়। ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আসেন রুখমিলা জামান। তিনি যুক্তরাজ্যে অবস্থান করায় তার পক্ষে সাইফুজ্জামান চৌধুরীই ব্যাংকটি পরিচালনা করতেন। এই সময়ে এসব অনিয়ম হয় বলে নিরীক্ষায় বলা হয়। নিয়ম অনুযায়ী, মন্ত্রী হলে ব্যাংকের পরিচালক-চেয়ারম্যান হওয়া যায় না, অথচ ইউসিবির প্রায় সব পরিচালনা পর্ষদ সভায় সশরীরে উপস্থিত থাকতেন ভূমিমন্ত্রী; যা সম্পূর্ণ বেআইনি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
Leave a Reply