বিশেষ সংবাদ:
লেখক, প্রকাশক আর পাঠকের অপেক্ষা ঘুচিয়ে অমর একুশে বইমেলার পর্দা উঠছে আজ । শেষ মুহূর্তে এসে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলছে সাজসজ্জা ও বই গোছানোর কাজ।
বায়ান্নোর ভাষাশহীদদের স্মৃতিবিজড়িত মাস ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন বিকাল ৩টায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে মেলা উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতবারের মত এবারও মেলার প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে ‘পড়ো বই গড়ো দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’।
এবারের বইমেলা হবে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রায় সাড়ে ১১ লাখ বর্গফুট জায়গায়। ৬৩৫টি প্রতিষ্ঠানকে মোট ৯৩৭টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এর মধ্যে একাডেমি প্রাঙ্গণে ১২০টি প্রতিষ্ঠানকে ১৭৩টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৫১৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৭৬৪টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মেলায় ৩৭টি (একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৩৬টি) প্যাভিলিয়ন থাকবে।
গতবছর বইমেলায় অংশ নিয়েছিল ৬০১ প্রতিষ্ঠান। সেই হিসাবে এবার প্রকাশনা সংস্থা বেড়েছে ৩৪টি।
বুধবার বিকালে বইমেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা যায়, বাংলা একাডেমি অংশে মেলার স্টল তৈরির কাজ প্রায় শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। তবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের কাজ এখনও পুরোপুরি
সেখানে কিছু প্যাভিলিয়ন বা স্টলের কাজ পুরোপুরি শেষ হলেও বেশির ভাগ স্টলে চলছে রঙের কাজ। শেষ মুহূর্তের ছোটখাটো কাজের ঠুকঠাক শব্দও শোনা গেছে অনেক স্টল থেকে। কোনো কোনো স্টলে চলছে সাজসজ্জার কাজ।
তবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মাঠে ইট বিছানো, পানি ছিটানো ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ এখনও বাকি রয়েছে।
এবার বাংলা একাডেমি কোনো ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব না দিয়ে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় মেলার আয়োজন করছে। একটু বিলম্বে গত ২৩ জানুয়ারি লটারির মাধ্যমে স্টল ও প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ কারণে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কাজ এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি বলে জানাচ্ছেন প্রকাশকরা।
পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহ-সভাপতি শ্যামল পাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবার দেরিতে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গত ২৩ জানুয়ারি সন্ধ্যার সময় তারা লটারি করেছে। সেদিন তো আর কাজ হয়নি।
“২৪ তারিখে কাজ শুরু হয়েছে। এই অল্প দিনে কীভাবে কাজ সম্পন্ন করা যায়? মিনিমাম ১০ দিন তো সময় লাগে। এ কারণে এবার অগোছালো হচ্ছে, যথাসময়ে কাজ শেষ করতে পারছে না।”
প্রকাশনা সংস্থা পুঁথিনিলয়ের কর্ণধার শ্যামল পাল বলেন, “মাঠের কাজও বাকি আছে। বাংলা একাডেমির যে কাজগুলো করে দেওয়ার কথা ছিল, সেটা করতেও আরও দুদিন লাগবে। মাঠে ইট বিছানো হয়নি, ধুলোবালি, ময়লা আবর্জনা। কালকে প্রধানমন্ত্রী গেলে পরে যদি কাজটা করে, তাহলে আগাবে।”
আগামী প্রকাশনীর কর্ণধার ওসমান গনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিভিন্ন কারণে এবার যথাসময়ে মেলার প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়নি। জায়গা বরাদ্দ পেতে দেরি হয়েছে।
“তবে আমার ধারণা দুদিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রতিকূল অবস্থা উত্তরণের জন্য আগে থেকে ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা বই নিয়ে তৈরি। আজকে থেকে আমাদের বই সাজানো শুরু হয়েছে। যারা করতে পারেনি, কালকের মধ্যে সেগুলো করে ফেলবে।”
বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব কে এম মুজাহিদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বইমেলার প্রস্তুতি ৯৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়ে গেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেটা উদ্বোধন করেন, সেই জায়গায় আমাদের সমস্ত দৃষ্টি থাকে। অন্যপাশে কিছুটা সময় তো লাগবেই। সেটা দুয়েক দিনের মধ্যে নরমাল হয়ে যাবে।
“যখন উদ্বোধন হয়ে যাবে, তারপর থেকে বাকিটা কাজ সম্পন্ন হবে। আমি আগেই বলেছি, ওই পাশটা সম্পন্ন করতে একটু সময় লাগবে, কিন্তু এ পাশটা তো সম্পন্ন হয়ে গেছে। এ পাশটা যেহেতু উদ্বোধনের বিষয়, এখানে ১০০ পার্সেন্ট কাজ সম্পন্ন করতে হচ্ছে।”
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান
বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টায় বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেনের সভাপতিত্বে এক অনুষ্ঠান থেকে মেলা উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা অন্যদের মধ্যে থাকবেন।
এ অনুষ্ঠানে সরকারপ্রধান বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘কালেক্টেড ওয়ার্কস অব শেখ মুজিবুর রহমান: ভলিউম-২’ সহ কয়েকটি নতুন বই উন্মোচন করবেন। পাশাপাশি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩ প্রদান করবেন।
মেলার বিন্যাস
এবার বইমেলার বিন্যাস গতবারের মতো অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে। তবে কিছু আঙ্গিকগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিশেষ করে মেট্রোরেল স্টেশনের অবস্থানগত কারণে মেলার বের হওয়ার পথ এবার একটু সরিয়ে মন্দির-গেইটের কাছাকাছি স্থানান্তর করা হয়েছে। এছাড়া টিএসসি, দোয়েল চত্বর, এমআরটি বেসিং প্লান্ট এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউশন অংশে মোট ৮টি প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ থাকবে।
গত বছরের বইমেলায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের দিকের প্রবেশপথটি সপ্তাহে দুই দিন খোলা থাকত। এবার তা মেলা চলাকালে পূর্ণ সময় খোলা রাখার অনুমতি পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে মেলা পরিচালনা কমিটি।
খাবারের স্টলগুলো ইঞ্জিনিয়ারিং ইনিস্টিটিউশনের সীমানা-ঘেঁষে বিন্যস্ত করা হয়েছে। এগুলোকে এবার এমনভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে যাতে তা মেলায় আগত পাঠকের মনোযোগ বিঘ্নিত না করে। নামাজের স্থান, ওয়াশরুমসহ অন্যান্য পরিষেবা অব্যাহত থাকবে।
গতবছরের তো শিশুচত্বরকে রাখা হয়েছে মন্দির-গেইটে প্রবেশের ঠিক ডান দিকে বড় পরিসরে। এবার লিটল ম্যাগাজিন চত্বর স্থানান্তরিত হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্মুক্ত মঞ্চের কাছাকাছি গাছতলায়। সেখানে প্রায় ১৭০টি লিটলম্যাগকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
নিরাপত্তা
বইমেলার প্রবেশ ও বাইরপথে পর্যাপ্ত সংখ্যক আর্চওয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেলার সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবে পুলিশ, র্যাব, আনসার ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। মেলায় তিন শতাধিক ক্লোজসার্কিট ক্যামেরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেলা পলিথিন ও ধূমপানমুক্ত থাকবে।
মেলাপ্রাঙ্গণ ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকবে। মেলার পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও নিয়মিত পানি ছিটানো এবং প্রতিদিন মশক নিধনের সার্বিক ব্যবস্থা থাকবে বলে জানিয়েছে মেলা পরিচালনা কমিটি।
বুধবার সকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একুশে বইমেলার নিরাপত্তা প্রস্তুতি ঘুরে দেখার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ঢাকার পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান।
অমর একুশে বইমেলা ঘিরে জঙ্গি হামলার কোনো হুমকি না থাকলেও সব দিক মাথায় রেখে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন তিনি।
তিনি বলেছেন, “বই মেলা অসাম্প্রদায়িক আয়োজন। এই আয়োজনকে বিভিন্ন সময় হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে।
“এখানে নাশকতা ও জঙ্গি তৎপরতার ঘটনা অতীত ঘটেছে। এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে মাথায় রেখে নিরাপত্তা পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে। তবে সুনির্দিষ্ট কোনো হুমকি নেই।”
বইমেলার সময়সূচি
২০২৪ সাল লিপইয়ার বা অধিবর্ষ। ফলে মেলার মাস ফেব্রুয়ারি পাবে ২৯ দিন। ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মেলা খোলা থাকবে। রাত সাড়ে ৮টার পর নতুন করে কেউ মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে পারবেন না।
ছুটির দিন বইমেলা চলবে বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। প্রতি শুক্র ও শনিবার বেলা ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত মেলায় ‘শিশুপ্রহর’ থাকবে।
প্রতিদিন বিকাল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে সেমিনার এবং সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থাকবে।
২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে মেলা শুরু হবে সকাল ৮ টায়, চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত।
অমর একুশে উদযাপনের অংশ হিসেবে শিশুকিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি এবং সংগীত প্রতিযোগিতার আয়োজন থাকছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকবে।
বইমেলায় বাংলা একাডেমি এবং মেলায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ২৫ শতাংশ কমিশনে বই বিক্রি করবে। এবারের মেলায় বাংলা একাডেমি প্রকাশ করছে নতুন ও পুনর্মুদ্রিত ১০০টি বই।
ইতিহাসের পাতায়
১৯৭২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির গেইটে চট বিছিয়ে বই বিক্রি শুরু করেন প্রকাশনা সংস্থা মুক্তধারা’র প্রতিষ্ঠাতা চিত্তরঞ্জন সাহা।
১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানমালার সাথে সঙ্গতি রেখে একাডেমির ভেতরে ছোট একটি স্টল স্থাপন করে বই বেচে মুক্তধারা। ১৯৭৭ সালে মুক্তধারার সঙ্গে আরও অনেকে যোগ দেয়, সেই থেকে একুশে বইমেলার সূচনা।
১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী একাডেমিকে এ বইমেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন। এর পরের বছরই বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি মেলার সঙ্গে যুক্ত হয়।
বইমেলা শুরুর আগের দিন বুধবার সকাল থেকেই বই আনা ও গোছানোর নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন দোকানিরা
বইমেলা শুরুর আগের দিন বুধবার সকাল থেকেই বই আনা ও গোছানোর নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন দোকানিরা |
মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকার সময় ১৯৮৩ সালে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে এ মেলা আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়া হলেও তা করা যায়নি। পরের বছর থেকে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে সূচনা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা।
মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের মাস ফেব্রুয়ারিজুড়ে বাংলা একাডেমির এই বইমেলা এখন বাঙালির মননের মেলায় পরিণত হয়েছে।
১৯৮৪ সাল থেকে বাংলা একাডেমি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নাম দিয়ে ধারাবাহিকভাবে মেলা পরিচালনা করছে।
২০২০ সালের মেলার উদ্বোধনপর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে ‘গ্রন্থমেলা’র পরিবর্তে ‘বইমেলা’ শব্দটি ব্যবহার অধিক শ্রুতিমধুর ও পাঠকপ্রিয় হবে বলে মত প্রকাশ করেন। এর পরের বছর বইমেলার প্রাতিষ্ঠানিক নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে বইমেলা’।
Leave a Reply