বিশেষ প্রতিবেদন :
চলমান বিতর্কের মধ্যেই আলাদা হয়ে যাচ্ছে প্রশাসন ক্যাডার। বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস (বিএএস) নামে তাদের আলাদা করা হচ্ছে। শুধু প্রশাসন নয় পুলিশ, পররাষ্ট্র, ট্যাক্স, কাস্টমসকেও আলাদা সার্ভিস করার সুপারিশ আসছে। আর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বিষয়টি সমন্বিতভাবে তদারকির জন্য আরও একটি পিএসসি করার চিন্তা থেকে এখনো সরেনি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন।
সংস্কার কমিশনের সদস্যরা নানা ইস্যুতে জনপ্রশাসনের বিভিন্ন ক্যাডারের সাবেক সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। তারা প্রশাসন ক্যাডারকে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে রূপান্তর করার পরামর্শ দিয়েছেন। আবার প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাও তাই চাচ্ছেন। এ অবস্থায় অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস করার কোনো বাধা দেখছেন না সংস্কার কমিশনের সদস্যরা। কমিশন-সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
এদিকে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ জমা দেওয়ার আগেই প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় তা নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, ‘কমিশনের সদস্যরা সংবাদ সম্মেলন করে সুপারিশ ফাঁস করার ঘটনা নজিরবিহীন। বিশ্বের কোথাও এমনটা হয় না। এমনকি বাংলাদেশেও কখনো এটা ঘটেনি। কমিশন সদস্যদের অদক্ষতায় আজ পুরো প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়েছে। প্রায় সব ক্যাডার মাঠে নেমেছেন, যা সরকারের জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর। ইতিমধ্যেই সংশ্লিষ্টদের কাছে বিষয়টি জানতে চাওয়া হয়েছে এবং তাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। সংস্কারের বিষয়ে যে সাপোর্ট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়ার কথা ছিল, তাও পাওয়া যাচ্ছে না।’
গত ১৭ ডিসেম্বর সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করে সংস্কার কমিশন। সেখানে কমিশন সদস্য এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমান জানিয়েছেন, কমিশন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডার আলাদা করার সুপারিশ করবে। উপসচিব পদে প্রশাসন ও অন্যান্য ক্যাডারের পদোন্নতি হবে ৫০ অনুপাত ৫০। লিখিত পরীক্ষা দিয়ে পদোন্নতি নিতে হবে। মোখলেস উর রহমানের এসব তথ্য ছড়িয়ে পড়লে বিস্ময় প্রকাশ করেন বিভিন্ন ক্যাডারের নেতৃস্থানীয়রা। প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের বক্তব্য হচ্ছে, তারা ৫০ অনুপাত ৫০-এ পদ্ধতি চান না। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডার কর্মকর্তারা বলছেন, তারা কোনোভাবেই আলাদা হতে চান না। তাদের চলমান পদ্ধতিতেই রাখতে হবে।
বরাবরের মতো চলমান বিতর্কেও প্রশাসন ক্যাডার একলা চলো নীতিতেই রয়েছে। আর শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডার অবশিষ্ট ক্যাডারকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করছে। এ অবস্থায়ও বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস করার পথেই রয়েছে কমিশন। কিন্তু বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস গঠন করলে দেশের প্রশাসনে গুণগত কোনো বদল আসবে কি না জানতে চাইলে সাবেক একজন সচিব দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রশাসন ক্যাডারকে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস করা হলে তাৎক্ষণিক কোনো পরিবর্তন আসবে না। তবে এর দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে, যা আমরা ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুরসহ আরও অনেক দেশে দেখতে পাই। গুণগত পরিবর্তন আনতে হলে নিয়োগ ও পদোন্নতি সিলেবাসে পরিবর্তন আনতে হবে। বিধিমালায়ও পরিবর্তন আনতে হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে ওই সচিব বলেন, ‘অন্য ক্যাডারগুলোও পৃথক পৃথক সার্ভিসে পরিণত হবে। তাদের পদোন্নতি বাড়বে। গ্রেড বাড়বে। ভারতে কেউ ভাবতেই পারে না ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসের বাইরে অন্য সার্ভিস থেকে কেউ সচিব হবেন। তবে কিছু ব্যতিক্রমের সুযোগ রাখা আছে। চার-পাঁচটি মন্ত্রণালয় বিজ্ঞানভিত্তিক। সেখানে তারা বিজ্ঞানীকেই সচিব বানায়। নিজস্ব সার্ভিসে উচ্চতম গ্রেডে যাওয়ার সুযোগ আছে।’
বাংলাদেশের প্রশাসনিক পদ্ধতিতে বর্তমানে নিয়ম হচ্ছে, উপসচিব পদে ৭৫ শতাংশ প্রশাসন ক্যাডার আর ২৫ শতাংশ বাকি ২৬টি ক্যাডার থেকে পদোন্নতি পান। কিন্তু অন্যান্য ক্যাডার থেকে যারা উপসচিব হন, তাদের পদায়ন করতে গিয়ে জটিলতায় পড়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। জনপ্রশাসনের একজন অতিরিক্ত সচিব জানান, পোস্টিং দিলেও অন্যান্য ক্যাডার থেকে মার্জ হওয়া অফিসারদের কোনো মন্ত্রণালয় নিতে চায় না। মন্ত্রণালয়গুলোর অভিযোগ, মার্জ হওয়া কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ থাকে না, মন্ত্রণালয়ের কাজের ধরনও বোঝেন না। এসব যোগ্যতা অর্জনের বিষয়গুলো নির্ভর করে মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব কাজের ধরনের ওপর। সেসব কাজের সঙ্গে তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতাই থাকে না। তারা তাদের বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নেন। আর প্রশাসন ক্যাডারের প্রশিক্ষণ থাকে সরকারের পলিসি ও সার্বিক বিষয়ের ওপর। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম অডিট, কাস্টমস ও ট্যাক্সেশন ক্যাডার। তাদের কেউ কেউ সচিবালয়ের কাজে দক্ষতার পরিচয় দেন।
জানা গেছে, স্বাধীনতার শুরুতেও দুটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন বা পিএসসি ছিল। একটা পাবলিক সার্ভিস কমিশন অন্যটি পাবলিক সার্ভিস সেকেন্ড কমিশন। সেকেন্ড কমিশন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করত। পরে এ পদ্ধতি বাতিল করে বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটি (ডিপিসি) করা হয়, যা এখনো বহাল আছে। পিএসসির ক্ষমতা ডেলিগেট করে দেওয়া হয়েছে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের জন্য একটা পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) করার কথা ছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগমুহূর্তে স্বাভাবিকভাবেই আগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো গুরুত্ব পায়। তখন সরকারের মনে পড়ে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের জন্য পিএসসি করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তাদের ডেকে পাঠালে তারা যতটা সম্ভব দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, সরকার এটা করতে পারে না। কারণ পিএসসি হবে সরকারি চাকরির জন্য। এটার নামের মধ্যেই আছে সরকারি কর্ম কমিশন। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ হচ্ছে ম্যানেজিং কমিটি বা পরিচালনা পর্ষদ। সংবিধান সরকারকে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের নিয়োগের জন্য পিএসসি করার এখতিয়ার দেয়নি। এরপর সেখান থেকে সরে আসে সরকার।
এরশাদ সরকারের সময়ও স্বাস্থ্য খাতে সংস্কারের চেষ্টা করা হয়। ওই সময় দশটা মেডিকেল কলেজ ছিল। ওই মেডিকেল কলেজগুলোকে কেন্দ্র করে দশটা আঞ্চলিক স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ গঠন করার প্রস্তাব ছিল। ডাক্তারের চাকরি হওয়ার কথা ছিল এসব কর্তৃপক্ষের অধীনে। এতে তাদের সুবিধা হতো। আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষ থাকলে পঞ্চগড়ের একজন চিকিৎসক ঢাকায় না এসে রংপুরেই চিকিৎসা দিতে পারতেন। এখানে ডাক্তার ও রোগী উভয়ই লাভবান হতেন। এখন ডিজি হেলথ একজন। তখন এই ডিজির নামই হতো চেয়ারম্যান। তখন চেয়ারম্যান হতেন দশজন। তাদের জন্য লাভজনক ছিল কর্তৃপক্ষ করা। তারা ওই সময় বুঝতে পারেননি। বন্ধ করার জন্য রাজপথে নেমেছিলেন। আন্দোলন হলেই তো সরকার এগোতে পারে না। কিন্তু সংস্কার না হলে দিনশেষে চিকিৎসকরাই বঞ্চিত হবেন বলে মনে করেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
বর্তমানে পিএসসির কাজের চাপ অনেক বেড়ে গেছে। বিশেষ করে শিক্ষক এবং চিকিৎসক নেওয়ার ক্ষেত্রে। বিসিএসে চিকিৎসকের সংখ্যা ৩০ ভাগেরও বেশি। শিক্ষকের সংখ্যাও প্রায় ২০ ভাগ। দুটি মিলে অর্ধেক। এসব শিক্ষক বা চিকিৎসকের ১১০০ নম্বরের পরীক্ষা দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ডাক্তারি বিষয়ে তার যে জ্ঞান থাকার কথা, সেটা থাকলেই হলো। একইভাবে যে বিষয়ের শিক্ষক সেই বিষয়ে তার পান্ডিত্য থাকাটাই যথেষ্ট। সব পরীক্ষা নেওয়ার বর্তমান যে পদ্ধতি, এটাতে অনেক সময় লাগছে। মূলত এ দুই ক্যাডারের কারণেই এক বছরের বিসিএস চার বছর লাগছে। পিএসসির এ বিনিয়োগ কোনো কাজে লাগছে না। এখনো প্রচলিত যে পদ্ধতি, তাতে ডাক্তাররা ১১০০ নম্বরের পরীক্ষা ছাড়াই নিয়োগ পাচ্ছেন। বিশেষ বিসিএস আয়োজনের নামে তাদের এ সুযোগ দেওয়া হয়। পিএসসি নানাভাবে এ ক্ষেত্রে সংস্কার আনার চেষ্টা করেছে। তাদের চাপেই সরকার ২০১৫ সালে শিক্ষক এবং স্বাস্থ্যের জন্য আলাদা পিএসসি করে দেওয়ার কাজ শুরু করে। কিন্তু তখনো স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্যাডারের আপত্তিতে সংস্কার করা যায়নি।
জনপ্রশাসনের বর্তমান পদ্ধতি জিয়াউর রহমানের সংস্থাপন মন্ত্রী মাজেদুল হকের সৃষ্টি। তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন। তাই আর্মির একটা রিফ্লেকশন বর্তমান প্রশাসনেও আছে। আর্মিতে বিভিন্ন কোর থাকে। সেই কোরের আদলেই সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে করা হলো ক্যাডার। একই বিষয়, শুধু দুই নামে ডাকা। বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও সমন্বিত সিভিল সার্ভিস বিষয়টা নেই। প্রতিটি বিষয় আলাদা। ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস (আইএএস), ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিস (আইএফএস) ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিস (আইপিএস) এভাবে বিষয়গুলো আলাদা করে দেওয়ায় বিশেষায়িত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ইন্ডিয়ান হেলথ সার্ভিস বা ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিস বলে কিছু নেই। এগুলো আছে রাজ্যভিত্তিক।
Leave a Reply