বিশেষ প্রতিবেদন :
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজবের ‘মহোৎসবের’ জন্য জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত ‘পলাতক অপশক্তিকে’ দায়ী করে সামগ্রিক ঐক্য দিয়ে সব ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি বলেছেন, “‘গুজব’ হলো এই জুলাই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে পরাজিত শক্তির মস্ত বড় হাতিয়ার। গুজব দেখলেই গুজবের সূত্রের সন্ধান করতে থাকবেন। গুজবকে অবহেলা করবেন না।”
অভ্যুত্থান দমাতে যারা ‘গণহত্যায়’ জড়িয়েছিল, এদেশের মাটিতে তাদের বিচার করার প্রতিশ্রুতি আবারো তুলে ধরেছেন সরকারপ্রধান।
ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে সকল রাজনৈতিক দলের মতামত নেওয়ার কাজ চলছে জানিয়ে তিনি বলেছেন, “আমাদের দায়িত্ব, জাতির সামনে পুরো প্রক্রিয়াটা স্বচ্ছভাবে তুলে ধরা এবং প্রক্রিয়া শেষে নির্বাচনের আয়োজন করা।”
স্বাধীনতা দিবস ও ঈদুল ফিতর সামনে রেখে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস। তার এই ভাষণ রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যমে একযোগে প্রচার করা হয়।
ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে গত ৫ অগাস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে।
৮ অগাস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ শপথ গ্রহণ করে। অভ্যুত্থানের জনপ্রত্যাশা মাথায় রেখে রাষ্ট্রসংস্কারের জন্য ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা এবং পরবর্তী নির্বাচনের জন্য ‘উপযুক্ত পরিবেশ’ তৈরির জন্য এ সরকার কাজ করছে।
গত কিছুদিন ধরে নানামুখী গুজব ছড়ানোর প্রসঙ্গ ধরে ইউনূস তার ভাষণে বলেন, “আপনারা জানেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজবের যেন এক মহোৎসব চলছে। দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য একের পর এক মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চলছে।
“অভিনব সব প্রক্রিয়ায় গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এক ছবির সঙ্গে অন্য ছবি জুড়ে দেওয়া হচ্ছে, ঘটনা একটা ছবি আরেকটা এরকম ফটোকার্ড বানিয়ে, অন্য দেশের ঘটনাকে এ দেশের ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় করে ফেলছে। যতই নির্বাচন কাছে আসবে এর রূপ আরও ভয়ঙ্কর হতে থাকবে।”
কারা এর পেছনে আছে, কেন আছে, তা ‘সবারই জানা’ মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমরা এই গুজব ও মিথ্যা তথ্যের প্রচারণা রোধ করতে জাতিসংঘের সহযোগিতা চেয়েছি। জাতিসংঘ মহাসচিব এর মোকাবিলায় আমাদের সহযোগিতা করবেন বলে আশ্বাস দিয়ে গেছেন।”
ইউনূস বলেন, “দেশবাসীকে আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম পর্ব সফলভাবে সমাপ্ত হয়েছে। প্রথম পর্বের সমাপ্তির মধ্য দিয়ে অভ্যুত্থানের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হলো। সবসময় মনে রাখতে হবে আমরা কিন্তু যুদ্ধাবস্থায় আছি।”
এই সময়ে গুজবকে ‘অবহেলা না করার’ আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “বহু অভিজ্ঞ সমর বিশারদ এই গুজবের পেছনে দিনরাত কাজ করছে, সীমাহীন অর্থ এর পেছনে নিয়োজিত আছে। এর মূল লক্ষ্য জুলাই অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করা। আমরা তাকে ব্যর্থ হতে দেব না।”
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের দিকে ইংগিত করে ইউনূস বলেন, “আমাদের সামগ্রিক ঐক্য পলাতক শক্তির গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে। তারা এই ঐক্য ভাঙতে চায়। তাদের অভিনব কৌশল আপনি টেরই পাবেন না। আপনি বুঝতেই পারছেন না কখন তাদের খেলায় আপনি পুতুল হয়ে গেছেন।
“আমাদের সচেতনতা এবং সামগ্রিক ঐক্য দিয়েই এই গুজবকে রুখতে হবে। পলাতক অপশক্তির ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দিতে হবে।”
ঐকমত্য ও নির্বাচন
রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগের অংশ হিসেবে গঠিত কমিশনগুলোর সুপারিশের ভিত্তিতে এখন ঐকমত্য গঠনের কাজ করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, যার নেতৃত্বে আছেন প্রধান উপদেষ্টা নিজে।
সেই কমিশনের কাজের অগ্রগতি তুলে ধরে ইউনূস বলেন, “ছয়টি সংস্কার কমিশনের ১৬৬টি সুপারিশ ও পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনসহ ৩৮টি রাজনৈতিক দলের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো খুবই ইতিবাচকভাবে সংস্কারকাজে সাড়া দিয়েছে, তাদের মতামত তুলে ধরছেন।
“কোন রাজনৈতিক দল কোন কোন সংস্কার প্রস্তাবে একমত হয়েছে, কোনটিতে দ্বিমত হয়েছে–সেসব তারা জানাচ্ছেন। এটা আমাদের জাতির জন্য অত্যন্ত সুখকর বিষয় যে, প্রতিটি রাজনৈতিক দল সংস্কারের পক্ষে মত দিচ্ছেন।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে সকল রাজনৈতিক দলের মতামত নেয়ার কাজ এখন চলমান আছে। কমিশনের লক্ষ্য হচ্ছে যে সকল বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলি একমত হবে সেগুলি চিহ্নিত করা এবং তার একটা তালিকা প্রস্তুত করা। যেসকল দল এতে একমত হয়েছে তাদের স্বাক্ষর নেয়া। এই তালিকাটিই হবে জুলাই চার্টার বা জুলাই সনদ।”
এই পুরো প্রক্রিয়া জাতির সামনে ‘স্বচ্ছভাবে তুলে ধরা’ এবং প্রক্রিয়া শেষে নির্বাচনের আয়োজন করার জন্যই সরকার কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, “নির্বাচনের ব্যাপারে আমি আগেও বলেছি, আবারও বলছি, এ বছর ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে।
“আমরা চাই, আগামী নির্বাচনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচাইতে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হোক। এজন্য নির্বাচন কমিশন সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো ব্যাপক উৎসাহ, উদ্দীপনায় নির্বাচনের জন্য তৈরি হতে শুরু করবে বলে আশা করছি।”
‘বিচার হবেই’
জুলাই-অগাস্টে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জাতিসংঘের প্রতিবেদন নিয়েও কথা বলেন মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি বলেন, “পতিত স্বৈরাচারের নিপীড়নের বর্ণনা উঠে এসেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের কার্যালয়ের রিপোর্টে। গত জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার ওপর শেখ হাসিনা সরকার ও আওয়ামী লীগ যে দমন-নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে এর পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তারা।
“এই রিপোর্টে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে যে, শেখ হাসিনা নিজেই নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন বিক্ষোভকারীদের হত্যা করতে। বিগত সরকার, আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের সহযোগী গোষ্ঠী ও সংগঠন একত্রিত হয়ে পরিকল্পিতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত ছিল।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিক্ষোভ চলাকালে প্রায় ১,৪০০ জন নিহত হয়েছেন। যার মধ্যে প্রায় ১৩ শতাংশ শিশু। বিক্ষোভের সম্মুখসারিতে থাকার কারণে, আমাদের জুলাই-কন্যারা নিরাপত্তা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে, এমনকি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
“জাতিসংঘের রিপোর্ট পড়ে সবার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে। কী ভয়াবহতা! কীভাবে একজন প্রধানমন্ত্রী নিজ দেশের নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার পর লাশ লুকিয়ে ফেলার নির্দেশ দিতে পারে! ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার জন্য তিনি পৃথিবীর সকল নিষ্ঠুরতা ছাড়িয়ে গেছেন—এটাই জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।”
ইউনূস বলেন, “মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার কার্যালয়ের এই রিপোর্টকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিবেদনে যে সুপারিশ করা হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার সে সুপারিশগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে।
“আপনাদেরকে আশ্বস্ত করে বলতে চাই, যারা গণহত্যায় জড়িত ছিল, যারা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে, যারা ইতোমধ্যে হত্যাকারী হিসেবে বিশ্বের কাছে স্বীকৃত তাদের বিচার এদেশের মাটিতে হবেই।”
স্মরণ ও শুভেচ্ছা
ভাষণের শুরুতেই একাত্তরের ২৫ মার্চের কাল রাতের কথা স্মরণ করেন প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “আজ ২৫ শে মার্চ, মানব সভ্যতার ইতিহাসে কলঙ্কিত এক হত্যাযজ্ঞের দিন। ১৯৭১ সালের আজকের রাতে পাক হানাদার বাহিনী নিরপরাধ, নিরস্ত্র, ঘুমন্ত বাঙালির ওপর নির্মমভাবে গুলি চালিয়ে হাজারো মানুষকে হত্যা করেছে। ২৫ শে মার্চ থেকেই এ দেশের মানুষ সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। ৯ মাসের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।
“মহান স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের; যাদের প্রাণের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ শহীদ ও দুই লাখ নির্যাতিত নারীর আত্মত্যাগ পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্ম দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের এই বীরদের প্রতি আমার সালাম।
“সেইসঙ্গে চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত হাজারো শহীদ ও আহত, যারা বৈষম্য, শোষণ, নির্যাতন এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল তাদের প্রতি সমগ্র জাতির পক্ষ থেকে আমি সশ্রদ্ধ সালাম জানাচ্ছি। জুলাই গণঅভ্যুত্থান আমাদেরকে যে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন পূরণের সুযোগ এনে দিয়েছে, সে সুযোগ আমরা কাজে লাগাতে চাই।”
পাশাপাশি দেশবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি বলেন, “পবিত্র মাহে রমজানের সিয়াম সাধনা উপলক্ষে আপনাদের সকলকে আমার আন্তরিক মোবারকবাদ জানাচ্ছি। সেইসঙ্গে, সকলকে জানাই পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের অগ্রিম শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক। এবারের ঈদ স্মরণীয়ভাবে আনন্দদায়ক হোক এই কামনা করছি।”
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “ঈদে পরিবার পরিজন নিয়ে নির্বিঘ্নে ও আনন্দ সহকারে নিজ নিজ বাড়ি যাবেন। আত্মীয়স্বজনের কবর জিয়ারত করবেন। গরিব পরিবারের খোঁজ খবর নিবেন, তাদের ভবিষ্যৎ ভালো করার জন্য চিন্তা ভাবনা করবেন, আপনার সন্তানদের সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দেবেন–এই কামনা করছি। ঈদের জামাতে দলমত নির্বিশেষে সবাই যেন পরাজিত শক্তির সকল প্ররোচনা সত্ত্বেও সুদৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকেন সেজন্য আল্লাহর কাছে মোনাজাত করবেন এই আহ্বান জানাচ্ছি।”
Leave a Reply