বিশেষ সংবাদ
বাসা থেকে হাসিমুখে রাজধানীর মালিবাগের জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে গিয়েছিলেন শিশু আহনাফ তাহমিন আয়হাম (১০)। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই সেই হাসি মিলিয়ে গেল চিরতরে। লাশ হয়ে পড়ে রইল তার দেহ হাসপাতালের স্ট্রেচারে।
মায়ের কান্না আর বাবার আহাজারি আর স্বজনদের আর্তনাদে হাসপাতালের বাতাস তখন ভারি হয়ে উঠেছে। স্বজনদের কাছে জানা গেছে, আয়হামের সুন্নতে খাতনা নিয়ে অনেক আয়োজন, উৎসব করার কথা ছিল। কিন্তু সব আনন্দ উৎসবের বাতাবরণকে ফিকে করে আয়হাম পাড়ি দিল না ফেরার দেশে। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া এই শিশুর মৃত্যুর দায় কার?আয়হামের জন্মের সময় তার পুরো পরিবার ফিনল্যান্ডের বাসিন্দা ছিলেন। দেশে ফিরে আসেন অনেকদিন আগেই। সুন্নতে খৎনাকে তেমন জটিল অপারেশন মনে করেননি তারা। মঙ্গলবার কাছের জেএস ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে আসা হয় আয়হামকে। সন্ধ্যায় ওটিতে নেয়ার পর আর ফিরে আসতে পারেনি ১০ বছরের আয়হাম। হাস্যোজ্জ্বল সন্তানের মরদেহ দেখার শোক কোনো ভাবেই মানতে পারছে না আয়হামের মা খাইরুন নাহার ও তার স্বজনরা।
স্বজনদের অভিযোগ, লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া দেয়ার কথা থাকলেও ফুল অ্যানেস্থেসিয়া দেয়া হয় আয়হামকে। পরে তার তার জ্ঞান ফেরেনি। রাজধানীর মালিবাগের জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে গতকাল মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি) এই ঘটনা ঘটে। মৃত শিশু শিশুটির পরিবার ও স্বজনদের অভিযোগ, ভুল চিকিৎসার কারণে আয়হামের মৃত্যু হয়েছে। খবর পেয়ে মেডিকেল সেন্টারটির দুই চিকিৎসককে গত রাতেই হাতিরঝিল থানায় নিয়েছে পুলিশ।
নামে ডায়াগনস্টিক ও চেকআপ সেন্টার হলেও ছোট করে হাসপাতালের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। হাসপাতালটিতে রোগী ভর্তি ও অপারেশন করা হতো নিয়মিত। পরিবারের দাবি, নিষেধ করা সত্ত্বেও শিশু আয়হামকে পুরো অজ্ঞান করা হয়েছে। যে কারণেই মৃত্যু হয় তার। তবে ভিন্ন কথা বলছে হাসপাতাল কতৃপক্ষ। তাদের দাবি, অপারেশন শেষে শিশুটি বমি করলে তা ফুসফুসে চলে যায়। পরে যা আর নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।
এ বিষয়ে জেএস ডায়গনষ্টিক ও চেকআপ সেন্টার হাসপাতালের পরিচালক এস এম মোক্তাদির বলেন, খৎনা লোকাল এনেস্থেশিয়া দেয়া হয়েছিল। বয়স দশ বছরের বেশি আর ওজন একটু বেশি হওয়ায় তার অ্যাংজাইটি রিলিফের জন্য অ্যানেস্থাইটিসের পরামর্শমতে ‘হাফ এম্পল সেডিল’ দেয়া হয়েছিল। একপর্যায়ে বমি শুরু হয় আয়হামের। বমি ফুসফুসে চলে গেলে তাকে বাচানোর জন্য সব ধরণের চেষ্টা করেও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
খবর পেয়ে মেডিকেল সেন্টারটির দুই চিকিৎসককে গত রাতেই হাতিরঝিল থানায় নিয়েছে পুলিশ। বিষয়টি নিয়ে হাতিরঝিল থানার সাব ইনসপেক্টর রুহুল আমিন বলেন, এ বিষয়ে মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ওই হাসপাতালের দুইজন ডাক্তারকে আটক করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
আয়হামের বাবা ফখরুল আলমের বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও ডাক্তার মুক্তাদির আয়হামের শরীরে ফুল অ্যানেসথেসিয়া পুশ করেন। এসব বলে হাসপাতালের করিডরে আহাজারি করছেন ফখরুল আলম। চিৎকার করে সন্তান হত্যার বিচার চাইছেন। তার চোখে জলের ধারা, কেউ কি শুনবেন তার কথা?
এদিকে দিনে দিনে অ্যানেস্থেশিয়া যেন রোগীদের কাছে আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। সুন্নতে খাতনা করাতে গিয়ে অ্যানেস্থেশিয়ার ভুল প্রয়োগে শিশু আয়ানের মৃত্যু নিয়ে চলমান বিতর্কে এবার গত সোমবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর ধানমন্ডি ল্যাবএইড হাসপাতালের আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) চিকিৎসাধীন অবস্থায় কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে রাহিব রেজা (৩১) নামক এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। রাহিব গ্যাসের সমস্যা নিয়ে চিকিৎসার জন্য ল্যাবএইড হাসপাতালে অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীলের কাছে যান। অধ্যাপক স্বপ্নীল রাহিবকে এন্ডোস্কোপি করানোর পরামর্শ দেন।
এন্ডোস্কোপি কক্ষে নিয়ে যাওয়ার পর প্রায় দেড় ঘণ্টা পেরিয়ে যায় কিন্তু রাহিবকে বের করা হয় না। বিলম্ব হচ্ছে দেখে রোগীর এক স্বজন এন্ডোস্কোপি কক্ষে ঢুকে তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় দেখতে পান। অবস্থার অবনতি দেখে এন্ডোস্কোপি কক্ষ থেকে তাকে হাসপাতালের আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার তিনি মারা যান।
এর আগে রাজধানীর ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খতনা করাতে গিয়ে শিশু আয়ানের মৃত্যু হয়। সেটি নিয়ে আদালতে মামলা চলমান। ৫ বছরের আয়ানেরও অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার পর জ্ঞান ফেরেনি। সাত দিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর গত ৭ জানুয়ারি তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা। এর এরপর মাস পেরোতে না পেরোতেই আরেক শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ উঠল।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলে বার্লিন ফ্রি ইউনিভার্সিটির শারিটে হাসপাতাল ক্যাম্পাসের প্রফেসর ড. ক্রিস্টফ স্টাইনের বরাত দিয়ে তাদের এক প্রতিবেদনে জানায়, বড়দের হাত বা অন্যত্র শিরায় টিউব বসিয়ে মেডিকেশন বা ওষুধ – যেমন অ্যানাস্থেসিয়া, অর্থাৎ অনুভূতিলোপের ওষুধ দেয়া চলে৷ একেবারে ছোট শিশুদের শিরা সংকীর্ণ ও নরম বলে তাদের মুখোশের ভেতর দিয়ে অ্যানাস্থেসিয়া দেয়াই ভালো – জানান ড. ক্রিস্টফ স্টাইন৷ মুখোশ দিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস নেয়ালে ছোটরা দৃশ্যত ঘুমায়ও ভালো৷
Leave a Reply